এনআরসির খসড়া তালিকা নিয়ে রাজনৈতিক দোষ পাল্টা
দোষ শুরু হয়েছে।এই এনআরসি লাঘু হলে হিন্দুত্বের এজেন্ডা বাস্তবায়ন হবে এবং গেরুয়া
শিবির সুবিধা পাবে।রাজনীতির এই কচকচানি কিন্তু আসামের রাজনৈতিক ইতিহাসের সাথে মেলে
না। আসামে এনআরসি লাঘুর জন্য শুরু থেকে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া পর্যন্ত বিজেপি
ক্ষমতায় ছিল মাত্র একবার।ইন্দিরা গান্ধির নাগরিকত্ব বিল, রাজীব গান্ধির উপস্হিতিতে
এনআরসি লাঘু করার চুক্তি আর আপডেট সময় কালের শাসন ক্ষমতায় রাজ্য এবং কেন্দ্রে
ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস।2009 সালে যখন এনআরসি সুপ্রীম কোর্টে যায় তখন কংগ্রেসের
মুখ্যমন্ত্রী তরুন গগৈ।অভিযোগ তার গড়িমসিতেই সুপ্রীম কোর্টে পৌঁছায় এবং একাধিকবার
আদালতের তারিখ মিস করে।2009 থেকে 2015 সাল পর্যন্ত তরুন গগৈয়ের সরকার আসামে
এনআরসির প্রযোজনীয়তার পরিবেশ নিয়ন্ত্রনে আনতে পারেন নি।16সালের এপ্রিলে বিজেপি
সরকার ক্ষমতায় এসে 17সালে প্রথম এনআরসির খসড়া তালিকা প্রকাশ করে।
এবার দেখে নেব আসামের রাজনৈতিক শাসন ক্ষমতার
পালাবদল --
2016 সালের এপ্রিলে আসামে বিধানসভা নির্বাচন হয়
। 126 আসনের মধ্যে বিজেপি জোট পায় 85টি আসন ।বিজেপি পায় 58টি,অসম গন পরিষদ পায়
14,বিপিএফ পায়12টি আর আইএনডি পায় একটি আসন ।কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বিরোধীরা পায় 37টি
আসন । কংগ্রেস পায় 24টি আর এআইইউডিএফ পায় 13টি আসন ।
আসামে 11 ফেব্রুয়ারী 1946 সাল থেকে 12 মার্চ 1978
সাল পর্যন্ত কংগ্রেসের পাঁচ জন মুখ্যমন্ত্রী সরকার পরিচালনা করে । 12মার্চ 1978
থেকে 11ডিসেম্বর 1979 বিজেপির দুজন মুখ্যমন্ত্রী বসে ।12 ডিসেম্বর 79 থেকে
5ডিসেম্বর 1980 পর্যন্ত রাষ্ট্রপ্রতি শাসন চলে । 6ডিসেম্বর 1980থেকে 30জুন 1981 কংগ্রেসের
মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ।এবং ফের রাষ্ট্রপ্রতি শাসন জারি হয় চলে 13 জানুয়ারী 1982
পর্যন্ত ।ফের শাসন ক্ষমতায় বসলেও কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রীকে সরতে হয় 19 মার্চ 1982
সালে এবং ফের রাষ্ট্রপ্রতি শাসন চালু হয় ।27 ফেব্রুয়ারী 1983 থেকে 23জিসেম্বর
1985পর্যন্ত কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য শাসন করেন । 24ডিসেম্বর প্রথম অসম গন
পরিষদ সরকার গঠন করে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার দখল করে শাসন করে1990 সালের 28 নভেম্বর
পর্যন্ত । 28 নভেম্বর 1990 থেকে 30জুন 1991 পর্যন্ত রাষ্ট্রপ্রতি শাসন ছিল । 30জুন
1991 থেকে 14মে 1996 সাল পর্যন্ত কংগ্রেস সরকার টিকিয়ে রাখে এবং কংগ্রেসকে হারিয়ে 15মে
1996 থেকে 17মে 2001 সাল পর্যন্ত আসাম শাসন করে অসম গন পরিষদ । 17মে 2001 থেকে 24
মে 2016 সাল পর্যন্ত কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী তরুন গগৈই রাজ্য পরিচালনা করেন ।24 মে
2016 সালে তরুন গগৈয়ের কংগ্রেস সরকারকে হারিয়ে ক্ষমতায় আসে বিজেপি ।
আসাম চুক্তি সর্ম্পকে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও
এনআরসি খসড়া তালিকা তৈরির টাইম লাইন জেনে নেই ----
ততকালিন প্রধানমন্ত্রী শ্রী রাজীব গান্ধীর
উপস্থিতিতে ১৯৮৫ সালের ১৫ ই আগস্ট নয়াদিল্লিতে ভারত সরকারের প্রতিনিধি হোম
সেক্রেটারি আরডি প্রধান এবং আসাম সরকারের হোম সেক্রেটারি পিপি ত্রিবেদির মাধ্যমে
আসাম আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। 1979 সালে অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (এএসইউ) অবৈধ অভিবাসীদের
সনাক্তকরণ ও নির্বাসন দাবিতে ছয় বছরের আন্দোলন এই আসাম চুক্তির স্বাক্ষরের মাধ্যমে
সমাপ্তি ঘটে।পরে আন্দোলনের নেতারা একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে এবং আসাম রাজ্যে সরকার
গঠনের পথ সুগম করে। ওই সময় চুক্তিটি আন্দোলনের অবসান ঘটালেও চুক্তির মূল ধারাটি
কার্যকর না করে কিছু বিষয়কে জিইয়ে রাখে এবং পরে সুপ্রিম কোর্টের হাতে চলে যায় ।
1990 সালে কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি আসাম
সরকারকে এএএসইউ এনআরসিকে আপডেট করার জন্য মডিউলগুলি জমা দেয় ।
1999 সালে আসাম চুক্তি অনুসারে এনআরসি আপডেট
করার বিষয়ে কেন্দ্র প্রথম আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ।
২০০5 সালের মে মাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী
মনমোহন সিংয়ের সভাপতিত্বে কেন্দ্র,
আসাম সরকার এবং এএএসইউয়ের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছিল
যেখানে একটি সমঝোতা হয়েছিল যে আসাম চুক্তিতে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য
এনআরসি আপডেট করার দিকে অবশ্যই পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। কেন্দ্রের পক্ষ থেকে আসাম
সরকারের সাথে পরামর্শ করে এনআরসি আপডেটের
কাজ শুরু করবে।
জুলাই ২০০9 সালে আসাম পাবলিক ওয়ার্কস নামে
একটি এনজিও সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছিল যে যে সমস্ত অভিবাসীর দলিল নথিভুক্ত
হয়নি তাদের ভোটার তালিকা থেকে সরিয়ে দেওয়া উচিত। এনজিও আদালতকে অনুরোধ করেছিল
যে এনআরসি আপডেট করার প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত।এভাবেই এনআরসি বিষয়টি সুপ্রিম
কোর্টে পৌঁছেছিল ।
আগস্ট 2013 সালে আসাম পাবলিক ওয়ার্কসের দায়ের
করা পিটিশন শুনানি শুরু হয় ।
ফেব্রুয়ারী 2015 : সুপ্রীম কোর্ট ২০১৩ সালের অবৈধ নাগরিকদের
চিহ্নিত করতে এবং অবৈধ অভিবাসীদের অনুপ্রবেশ রোধ করার জন্য এনআরসি আপডেট করার
নির্দেশ দিলেও কাজ শুরু হয় ফেব্রুয়ারি 2015 সালে ।
31 শে ডিসেম্বর2015 : এনআরসি প্রকাশের জন্য
সুপ্রিম কোর্টের নির্ধারিত সময়সীমা মিস করে সরকার এবং তখন থেকে শীর্ষ আদালত
নিয়মিত আপডেটটি নজরদারি করে চলেছে ।
31 ডিসেম্বর, 2017: সরকার এনআরসির প্রথম খসড়া প্রকাশ করে ।
30 জুলাই, 2018: আসাম সরকার দ্বিতীয় এনআরসি খসড়া প্রকাশ করে। আবেদনকারী ৩.২৯
কোটির মধ্যে ২.৯৯ কোটিকে প্রকৃত নাগরিক হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। খসড়া এনআরসিতে
৪০ লাখেরও বেশি লোককে বাদ পড়ে।
আগস্ট 1, 2018: সুপ্রিম কোর্ট রায়ে বলে, যে আসাম এনআরসি কেবল একটি খসড়া ছিল, তাই এটি কারও বিরুদ্ধে কোনও
কর্তৃপক্ষের কোনও পদক্ষেপের ভিত্তি হতে পারে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও.পি.
রাওয়াত স্পষ্ট করেছিলেন যে ভোটার তালিকাটি একটি পৃথক আইন দ্বারা পরিচালিত হয় এবং
চূড়ান্ত এনআরসি থেকে বাদ দেওয়া মানে আসামের ভোটার তালিকা থেকে "স্বয়ংক্রিয়
বাদ " দেওয়া হবে না।
আগস্ট 17, 2018: সুপ্রিম কোর্ট অসম এনআরসি সমন্বয়কারীকে রাজ্যের এনআরসি খসড়া
থেকে বাদ দেওয়া জনগোষ্ঠীর জেলাভিত্তিক শতাংশের তথ্য জমা দিতে বলে।
5 সেপ্টেম্বর, 2018: সুপ্রিম কোর্ট এক আদেশ বলে, যে এনআরসি দাবি ফর্মের তালিকায়
সরবরাহিত মোট 15 টি নথিগুলির মধ্যে 10 টির থেকে যে কোনও একটি নথি দাবিদাররা
উত্তরাধিকার প্রমাণের জন্য ব্যবহার করতে পারেন।
31 ডিসেম্বর, 2018: সরকারের পক্ষে এনআরসির চূড়ান্ত সংস্করণ প্রকাশের সময়সীমা
ছিল। তবে সময়সীমায় তা শেষ করতে পারেনি।
26 শে জুন, 2019: তালিকার একটি অতিরিক্ত খসড়া প্রকাশিত হয়েছিল। এই তালিকার 1,02,462 নাম ছিল, আর তালিকায়
বাদ যাওয়াদের মোট সংখ্যা ছিল 41,10,169 ।
জুলাই 31, 2019: সরকারের এনআরসির চূড়ান্ত সংস্করণ প্রকাশের কথা থাকলেও তা করতে
পারেনি তখন সময়সীমা এক মাস বাড়ানো হয়েছিল।
আগস্ট 31, 2019: সরকার এনআরসি-র চূড়ান্ত সংস্করণ প্রকাশ করে আসাম সরকার এবং 19
লক্ষেরও বেশি লোক তালিকা থেকে বাদ পড়ে।
এবার জেনে নেই এনআরসি সর্ম্পকে
ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন (এনআরসি) হ'ল
একটি সরকারী দলিল তালিকা।এই তালিকায় নাম থাকা ব্যক্তিরাই আসল ভারতীয় । ১৯৫১ সালে
এটি প্রথম প্রস্তুত করা হয়েছিল। ১৯৫১ সালে এনআরসি তালিকা তৈরি করা হয় অবৈধ
অভিবাসীদের তাড়াতে। এবং বিদেশী অনুপ্রবেশ থেকে আসামকে বাঁচাতে অনুপ্রবেশ বন্ধের
জন্য এনআরসি করা হয় ।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের কড়া নজরদারি ও
তদারকিতে ২০১৩ সালে এনআরসি আপডেট করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল । ডিসেম্বর,
2017 এ, এনআরসির একটি অংশ খসড়া প্রকাশিত হয়েছিল এবং
পরে 30 জুলাই, 2018 এ এনআরসির সম্পূর্ণ খসড়া প্রকাশ করা
হয়েছিল।এই সময় আসামের সরকার ছিল কংগ্রেসের।
এনআরসিতে নিবন্ধিত হওয়ার যোগ্য কারা ?
1951 এর এনআরসি তালিকায় যাদের নাম ছিল।
1971 সালের একাত্তরের 24 শে মার্চ অবধি
যে সকল নির্বাচনী তালিকাতে নাম ছিল।
বংশোদ্ভূত
1966 সালের জানুয়ারী বা তার পরে বিভিন্ন
অঞ্চল থেকে আসা কিন্তু ২৫ শে মার্চ, 1971 এর আগে এবং ফরেনার্স রেজিস্ট্রেশন
রিজিওনাল অফিসার্সের (এফআরআরও) থেকে
শংসাপত্র নেওয়া ও বিদেশি ট্রাইব্যুনাল ভারতীয় নাগরিক হিসাবে ঘোষিত করেছে এমন
ব্যক্তিরা আবেদন করতে পারবেন।
২৪ শে মার্চ, 1971 সালের পরে
তাদের আত্মীয়স্বজনসহ যে ভারতীয় নাগরিক আসামে চলে এসেছিল (২৪ শে মার্চ, 1971
অনুযায়ী তাদের দেশের অন্য কোনও অঞ্চলে
আবাসের প্রমাণ দিতে হবে।)
ডি ’ভোটাররা আপডেট হওয়া এনআরসিতে তাদের
নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করতে পারবেন । আবার উপযুক্ত বিদেশি ট্রাইব্যুনাল
তাদের বিদেশি নয় হিসাবে ঘোষণা করলেই তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
নাগরিকত্বের জন্য গ্রহণযোগ্য নথির তালিকায়
উল্লিখিত ব্যক্তিরা 24 মার্চ, 1971 সালের মধ্যরাত
পর্যন্ত জারি করা যে কোনও নথিপত্র সরবরাহ করতে পারেন।
এনআরসিতে নিবন্ধিত সুবিধা কী কী?
এনআরসি অবৈধ অভিবাসীদের শনাক্তকরণের ভিত্তি
তৈরি করবে, অন্তর্ভুক্তি হয়রানির হাত থেকে রক্ষা করবে এবং
সংবিধানের সমস্ত অধিকার এবং সুরক্ষা এবং সরকারী প্রকল্পের সুবিধা ভোগ করার টিকিট পাবে।
আমি যদি এনআরসি-তে নিজেকে নিবন্ধিত না করি তবে
কী হবে?
আপনি যদি এনআরসি-তে নিজেকে নিবন্ধিত না করেন
তবে আপনি প্রশাসনিক / আইনি সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন। বিদেশী ট্রাইব্যুনালের কাছ থেকে একটি
নোটিশ পেতে পারেন। আপনি যদি নিজেকে প্রমাণ করতে না পারেন তবে আপনি রাষ্ট্রবিহীন
ব্যক্তি হিসাবে দেশত্যাগ বা জেলের মুখোমুখি হতে পারেন।
ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন (এনআরসি) হ'ল
একটি নিবন্ধ যা সমস্ত প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকের নামের দলিল। বর্তমানে কেবল আসামে এ
জাতীয় দলিল রয়েছে।
এই প্রক্রিয়া অন্য রাজ্যেও করা যেতে পারে।
নাগাল্যান্ড ইতিমধ্যে আদিবাসী বাসিন্দাদের নিবন্ধ হিসাবে পরিচিত একটি অনুরূপ
ডাটাবেস তৈরি করছে। কেন্দ্র একটি জাতীয় জনসংখ্যা নিবন্ধক (এনপিআর) তৈরি করার
পরিকল্পনা করছে, যাতে নাগরিকদের ডেমোগ্রাফিক এবং বায়োমেট্রিক
বিশদ থাকবে।
No comments:
Post a Comment