সন্তানদের ভালো লালন-পালনে অভিভাবকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়, শিশুরা মাটির মতো, তাদের যেভাবে ঢালাই করা হয়, সেভাবেই তারা ঢালাই করে। তাই শৈশব থেকেই তাদের এমন ছোটখাটো কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে বলা খুবই জরুরি, যা তাদের সুস্থ ব্যক্তিত্ব গঠনে সহায়ক হবে।
স্বাস্থ্যবিধি বিষয়:
শৈশব থেকেই শিশুদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিধি শেখানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ভাল ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি অভ্যাস শুধুমাত্র শিশুদের সুস্থ রাখে না, তবে তাদের সংক্রামক রোগ (যেমন কলেরা, ডায়রিয়া, টাইফয়েড ইত্যাদি) থেকে রক্ষা করে এবং একটি স্বাস্থ্যকর গঠনে সহায়তা করে। শিশুদের শরীর এবং সুস্থ ব্যক্তিত্ব। শিশুদের বোঝানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে ময়লা থেকে সৃষ্ট রোগগুলি জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে, তাই তাদের মৌখিক স্বাস্থ্যবিধি, পা এবং হাতের স্বাস্থ্যবিধি, ত্বক ও চুলের যত্ন, পায়খানার স্বাস্থ্যবিধি এবং বাড়ির স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে শেখান।
টাইম ম্যানেজমেন্ট:
বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানকে এই কৌশল শিখিয়ে স্মার্ট করে তুলতে পারেন। পড়াশোনার ক্রমবর্ধমান চাপের পরিপ্রেক্ষিতে এখন অনেক স্কুলে শিশুদের সময় ব্যবস্থাপনার কৌশল শেখানো হচ্ছে। টাইম ম্যানেজমেন্ট শেখার সবচেয়ে বড় সুবিধা হল এই কৌশলটি শুধুমাত্র তাদের স্কুল জীবনেই নয়, ভবিষ্যতের জন্যও খুবই উপকারী। সেজন্য বাবা-মায়ের উচিৎ শৈশব থেকে সময় পরিচালনা করতে শেখানো, যেমন-
* প্রথমে গুরুত্বপূর্ণ কাজের/বাড়ির কাজের তালিকা তৈরি করুন।
* কিভাবে কম সময়ে কাজ/বাড়ির কাজ শেষ করবেন?
* অন্যান্য ক্লাস/ক্রিয়াকলাপগুলির জন্য সময় দিন।
* কিভাবে স্ব-শৃঙ্খলায় থাকা যায়?
* ঘুম, খাওয়া এবং খেলার জন্য সময় নির্ধারণ করুন।
মানি ম্যানেজমেন্ট:
বাচ্চাদের মানি ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে বোঝানো খুবই জরুরী, যাতে তারা শৈশব থেকেই সঞ্চয় এবং অপব্যয়ের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারে এবং ভবিষ্যতে তারা অতিরিক্ত খরচ করা থেকে বিরত থাকে। তাদের শৈশব থেকেই শেখান যে কোথায় কীভাবে সঞ্চয় করতে হবে এবং ব্যয় করতে হবে, স্বল্পমেয়াদী বিনিয়োগ করতে শেখান। একইভাবে, ধীরে ধীরে কম্পিউটার, ল্যাপটপ ইত্যাদি কেনার জন্য তাদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
পিয়ার প্রেসার সামলানো:
সাইকিয়াট্রিস্টরা বিশ্বাস করেন যে পিয়ার প্রেসারের প্রভাব ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের মধ্যে দেখা যায়। সাধারণত 11-15 বছর বয়সী বাচ্চাদের বন্ধুদের কাছ থেকে বেশি চাপ থাকে, কিন্তু বাবা-মা এই চাপ বুঝতে পারেন না। আজকের পরিবর্তিত পরিবেশে, সমবয়সীদের চাপ শিশুদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তাই শিশুদের পথ দেখানোর দায়িত্ব পিতামাতার, যা তাদের মানসিক সমর্থন দেবে।
* তাদের মধ্যে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা গড়ে তুলুন।
* বাচ্চাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করুন, যাতে তারা আপনার সাথে সবকিছু শেয়ার করে।
* ভুল হলে ভালোবেসে বুঝিয়ে বলুন।
* শিশু চাপ সামলাতে না পারলে বা শিশুর আচরণে কোনো পরিবর্তন দেখা দিলে অবিলম্বে অভিভাবকদের উচিৎ তার শিক্ষক ও বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে বিস্তারিত তথ্য নেওয়া।
রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট:
রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট বাচ্চাদের মানসিক ও সামাজিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাই একজন অভিভাবক হিসেবে সন্তানের মধ্যে ইতিবাচক সম্পর্ক (সম্পর্ক ব্যবস্থাপনা) গড়ে তোলা শুরু করা আপনার দায়িত্ব হয়ে যায়, যেমন -
* তাদের সাথে শেয়ার করতে উৎসাহিত করা হয় তাদের বন্ধু এবং পরিবারের সদস্যদের পরিবারের সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দিন। সময়ে সময়ে, বাচ্চাদের তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিন বা ফোনে কথা বলুন।
* তাদের সাথে বেশি সময় কাটালে তাদের সাথে শিশুদের বন্ধন মজবুত হবে এবং সম্পর্কও মজবুত হবে।
* শিশুদের মধ্যে যোগাযোগের দক্ষতা বিকাশ করুন, যাতে তারা পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে পারে।
* শিশুদের সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করুন, যাতে তারা বেশি বেশি মানুষের সংস্পর্শে আসে।
* শিশুদেরকে শিশুবান্ধব পরিবেশ প্রদান করুন, যাতে তারা বিনা দ্বিধায় 'হ্যাঁ' বা 'না' বলতে পারে।
আত্মনিয়ন্ত্রণ:
এটি এমন একটি কাজ, যার প্রশিক্ষণ শৈশব থেকেই প্রয়োজন। আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শিশুরা শুধু বর্তমান নয় ভবিষ্যতেও অনেক ব্যক্তিগত ও পেশাগত সমস্যাকে উপেক্ষা করতে পারে। আত্মনিয়ন্ত্রণ শেখানোর জন্য-
* শিশুদের এমন কার্যকলাপে জড়িত করুন যা আত্মনিয়ন্ত্রণকে উৎসাহিত করে, যেমন খেলাধুলা, গান শোনা ইত্যাদি।
* তাদের ঘরের ছোট ছোট দায়িত্ব অর্পণ করুন, যেমন তাদের ঘর পরিষ্কার করা, বাচ্চাদের পার্টি করা, পোষা প্রাণীর যত্ন নেওয়া ইত্যাদি।
* তাদের সীমানা নির্ধারণ করুন। যদি শিশুটি পিতামাতা বা তাদের ভাইবোনদের সাথে আপত্তিজনকভাবে কথা বলে, অবিলম্বে বাধা দিন।
* তাদের শৃঙ্খলার মধ্যে থাকতে শেখান।
সিভিক সেন্স:
সন্তানদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা বাবা-মায়ের দায়িত্ব। সুনাগরিক হতে হলে শৈশব থেকেই তাদের নাগরিক জ্ঞান শেখানো খুবই জরুরি। তাদের নাগরিক বোধের প্রতি আপনার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বলুন, অর্থাৎ ঘরে নয়, বাইরেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার যত্ন নিন।
* সড়ক নিরাপত্তা নিয়ম মেনে চলা।
* পাবলিক প্লেসে ধৈর্য ধরুন।
* মানুষকে সম্মান দেওয়া।
* নারীদের সম্মান করা।
* দেশপ্রেমিক অনুভূতি ইত্যাদি অভিভাবকদের দায়িত্ব সন্তানদের বিভিন্নভাবে নাগরিক জ্ঞান শেখানো।
সোশ্যাল মিডিয়া সতর্কতা:
প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান প্রভাব থেকে শিশুরাও অস্পৃশ্য নয়, তাই শিশুদের সোশ্যাল মিডিয়া সম্পর্কিত কার্যকলাপের উপর কড়া নজর রাখা পিতামাতার দায়িত্ব হয়ে পড়ে। তারা কি 'পোস্ট' করছে এবং কার সাথে কথা বলছে? কেউ কি তাদের সোশ্যাল সাইটে হয়রানি করছে না?
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে শিশুরা সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশি সময় ব্যয় করে শুধু তাদের সময়ই নষ্ট করে না, এটি তাদের মেজাজেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বানান ও ব্যাকরণের কোনো নিয়ম নেই বলে মনে করেন স্কুল শিক্ষকরা। সোশ্যাল মিডিয়ায় চ্যাট করার সময়, ভুল বানান এবং ভুল ব্যাকরণের নিয়মগুলিও তার স্কুলের লেখার উপর প্রভাব ফেলছে। তাই অভিভাবকদের উচিৎ-
* শুধুমাত্র নির্ধারিত সময়সীমার জন্য ল্যাপটপ, স্মার্টফোন এবং ট্যাবলেট ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া।
* স্মার্টফোন, ট্যাবলেট এবং ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড সুরক্ষিত রাখুন।
* কিছুক্ষণ পর পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করতে থাকুন।
* নতুন পাসওয়ার্ড শিশুদের বলবেন না। তারা আপনার অনুমতি ছাড়া তাদের খুলতে সক্ষম হবে না
* শারীরিক কার্যকলাপের জন্য তাদের উত্সাহিত করুন।
No comments:
Post a Comment