১৯ শে ডিসেম্বর কলকাতা পুরভোট ঘিরে শুরু থেকেই ছিল টানটান উত্তেজনা। মোট ১৪৪ টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ এদিন। আঁটোসাঁটো নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হয় শহর। সকাল ৭ টা থেকে কলকাতায় মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে। কলকাতায় ১৪৪টি ওয়ার্ডে ২৩,৫০০ পুলিশ রয়েছে। সমস্ত বুথ, স্ট্রং রুম এবং গণনা কেন্দ্র ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
শুরুতে ভোট শান্তিপূর্ণ ভাবে শুরু হলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই বিক্ষিপ্ত অশান্তির সূত্রপাত হয়। কোথাও বুথ এজেন্টকে বসতে দেওয়া হচ্ছে না, কোথাও ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে, কোথাও আবার সিসিটিভি ক্যামেরাই ঢেকে দেওয়া হয়েছে, এসব অভিযোগ উঠতে থাকতে শাসক দলের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে বাম-বিজেপি। কলকাতার পাশাপাশি সেই বিক্ষোভের আঁচ ছড়িয়ে পড়ে কলকাতা সংলগ্ন জেলাগুলো যেমন- উত্তর ২৪ পরগনা, হাওড়াতেও। রাস্তায় বসে পথ অবরোধ, বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে বিরোধীরা। যদিও সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছে শাসক শিবির। পাল্টা বিরোধীদেরই কাঠগড়ায় তোলে তৃণমূল।
এদিন ৬৭ নং ওয়ার্ডে সিপিআইএম প্রার্থীর পরিবারের লোকদের ভয় দেখিয়ে ভোট দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। ১০৯ নং ওয়ার্ডেও তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস চালানোর অভিযোগ তোলেন বাম প্রার্থী শিখা পূজারী। তাদের বুথ এজেন্টদেরও বসতে না দেওয়া ও অন্যের হয়ে ভোট দেওয়ার অভিযোগও করেন তিনি।
এদিকে ২২ নং ওয়ার্ডে ভোটারকে মারধর করার অভিযোগ ওঠে এক যুবকের বিরুদ্ধে। ভোটারকে মেরে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে ধরে ফেলে বাকিরা। ঘটনাস্থলে আসে পুলিশও। এই নিয়ে শুরু হয় তুমুল বচসা।
বাগবাজার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের এক নম্বর বুথে বিজেপি প্রার্থী বোজেশ ঝাঁ অভিযোগ করেন, সেখানে ইভিএম মেশিনে কালো দাগ দিয়ে রেখে ভোটারদের প্রভাবিত করা হচ্ছে। সেক্টর অফিসার ঘটনাস্থলে এসে সেটা রিমুভ করে দেয় বলেও দাবী করেন বিজেপি প্রার্থী। এছাড়াও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের অধীনে পুলিশ ও বিজেপি কর্মীদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। অভিযোগ, বুথের ভিতরে বিজেপি প্রার্থী রূপা চৌধুরীকে নিয়ে আপত্তি করছে পুলিশ।
পাশাপাশি এই ওয়ার্ডের ৯ ও ১০ নং বুথ শ্রীরামকৃষ্ণ ডে স্টুডেন্টস হোমে বিজেপি প্রার্থী শ্রীকৃষ্ণ ঝাঁয়ের সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থকদ ও পুলিশের হাতাহাতি, বচসা বাঁধে। বিজেপির অভিযোগ, বুথের সামনে অযথা টিএমসি সমর্থকরা জটলা তৈরি করছে। তাদের এজেন্টকে বসতে দেওয়া হচ্ছে না। যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে তৃণমূল।
এখানেই শেষ নয়, একজন মহিলা কলকাতা পৌরসভার ১০২ নম্বর ওয়ার্ডের ২৩ নম্বর বুথে দুবার ভোট দিয়েছেন। পুরো ঘটনাটি প্রিসাইডিং অফিসারের সামনে ঘটলেও তাকে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। এর একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয় (ভাইরাল ভিডিওর সত্যতা যাচাই করেনি প্রেসকার্ড নিউজ) এবং একে কেন্দ্র করেই ছড়ায় ব্যাপক উত্তেজনা।
ওদিকে ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থী নন্দন ঘোষের অভিযোগ, তৃণমূল কর্মীরা চারটি সিসিটিভি ক্যামেরা কাগজ দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। একই অভিযোগ তুলেছে সিপিআই(এম)। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ওই ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী শচীন কুমার সিং। সংশ্লিষ্ট বুথের প্রিসাইডিং অফিসারও অভিযোগ অস্বীকার করেন। তার দাবী করেন, সকাল থেকেই বুথের সব ক্যামেরা সক্রিয় রয়েছে। এছাড়াও কোনও এক নারীর কাপড় ছিঁড়ে দেওয়ারও অভিযোগ ওঠে শাসক দলের বিরুদ্ধে।
পোস্তায় ২২ নম্বর ওয়ার্ডে ভুয়া ভোটার ধরার দাবী বিজেপি প্রার্থী মিনাদেবী পুরোহিতের। নারকেল ডাঙ্গায় ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপি প্রার্থী গিরিশ কুমার শুক্লাকে মারধরের অভিযোগ তৃণমূলের বিরুদ্ধে। তালতলা এলাকায় ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ছাপ্পা ভোটের অভিযোগে কংগ্রেসের। পাশাপাশি ভোটারদের প্রভাবিত করার পাল্টা অভিযোগ করেছে তৃণমূল। পুলিশের সামনেই ধস্তাধস্তিতে জড়িয়ে পরে উভয় পক্ষ।
এছাড়াও শিয়ালদায় ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের টাকি বয়েজ স্কুলের সামনে দফায় দফায় উত্তেজনা ও বোমাবাজি হয়। বোমার আঘাতে গুরুতর জখম হন এক ভোটার। এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
এই সকল অভিযোগ ঘিরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক ভাবেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। প্রতিবাদে বাম-বিজেপি বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। বাঘাযতীন মোড়ে বাম নেতা শমীক লাহিড়ীর নেতৃত্বে চলে বিক্ষোভ, অবরোধ কর্মসূচি। অবরোধ তুলতে গেলে পুলিশের সঙ্গে তুমুল ধস্তাধস্তিও হয় তাদের।
জানা যায়, এদিন দুপুর পর্যন্ত ভোটে অশান্তি করার অভিযোগে মোট ৭৪ জনকে গ্রেফতার করেছে কলকাতা পুলিশ।
ওদিকে বিক্ষোভের আঁচ ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য জেলাতেও। কলকাতা পুরসভার ভোটে অশান্তি নিয়ে হাবড়ার এক নম্বর রেলগেট লাগোয়া যশোর রোডের ওপর বিজেপি পথ অবরোধ এবং বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। অবরোধের জেরে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। যদিও পরবর্তীতে প্রায় কুড়ি মিনিট পর পুলিশের আশ্বাসে ওঠে অবরোধ উঠে যায়। হাবড়ার পাশাপাশি, হাওড়া ময়দানেও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে বিজেপি।
তবে নিজেদের বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে তৃণমূল। তৃণমূল প্রার্থী তথা রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, উৎসবের মেজাজে ভোট হচ্ছে। কিছু কিছু জায়গায় বিরোধীরা আগেই হেরে বসে আছে, তাই তারা মানুষের ওপর বিশ্বাস হারাচ্ছে। তারা কোথাও অভিযোগ করছে, হইহই করছে, কিন্তু আমি কমিশনকে বলব, সেখানে গিয়ে দেখতে আদৌ সেই ঘটনা ঘটেছে কি না! বিরোধীরা নিজেরাই বোম মেরে অশান্তি করে ঝামেলার পরিবেশ সৃষ্টি করছে, দাবী ফিরহাদের।
এ বিষয়ে হাবড়ার বিধায়ক তথা রাজ্যের বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককের গলাতেও একই সুর। তিনি বলেন, বিরোধীদের অভিযোগ পুরোপুরি ভিত্তিহীন। আর তাই নির্বাচন কমিশনও সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি বিরোধীদের মেরুদণ্ড শক্তিশালী নয় বলেও কটাক্ষ করেন বনমন্ত্রী।
পুরভোটে অশান্তির অভিযোগ প্রসঙ্গে তৃণমূলের সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'যদি এই ঘটনায় তৃণমূলের কেউ যুক্ত থাকে তাহলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দল ব্যবস্থা নেবে। সাংগঠনিক এবং প্রশাসনিক উভয় স্তরেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি বিরোধীদের কটাক্ষ করে অভিষেক বলেন, 'ওরা জানে মানুষের হৃদয়ের কোন স্থান নেই।' এদিন মিত্র ইনস্টিটিউশনে ভোট দিতে এসে একথা বলেন অভিষেক।
প্রসঙ্গত, কলকাতায় ১৪৪টি ওয়ার্ডে ২৩,৫০০ পুলিশ রয়েছে। সমস্ত বুথ, স্ট্রং রুম এবং গণনা কেন্দ্র ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। কলকাতা পুর অঞ্চলে মোট ভোটার সংখ্যা ৪০,৪৮,৩৫২। ৬৬ নম্বর ওয়ার্ডে সবচেয়ে বেশি ভোটার রয়েছে। ৯৫,০৩৮ টি ওয়ার্ডে সবচেয়ে কম ভোটার রয়েছে। এখানে ভোটার সংখ্যা ১০,০৩৩ জন। ৪৯৫৯টি বুথে ভোটগ্রহণ চলছে। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে ১১৩৯টি বুথ স্পর্শকাতর। কলকাতা পৌরসভার নির্বাচিত পুর বোর্ডের মেয়াদ ২০২০ সালের মে মাসে শেষ হয়েছিল।
No comments:
Post a Comment