নিজস্ব প্রতিনিধি, আলিপুরদুয়ার: সময় বদলাচ্ছে, তাঁর সঙ্গেই আমূল পরিবর্তন আসছে মানুষের জীবনধারায়, বদল আসছে মানুষের জীবন যাপন রীতিনীতিতেও। আর তারই সবচেয়ে বড় নিদর্শন উত্তরবঙ্গের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অসুর সম্প্রদায়ের মানুষজন। এক সময় যে অসুর সম্প্রদায়ের মানুষেরা দুর্গা পুজো দেখতেনই না। সময়ের সঙ্গে তারাও মূল স্রোতে ফিরতে শুরু করেছেন। এখন উত্তরবঙ্গের অনেক অসুর সম্প্রদায়ের মানুষ সামিল হচ্ছেন দেবী দুর্গার আরাধনায়।
অনেকেই দুর্গা পুজোয় নতুন জামাকাপড় পরে রীতিমতো মন্ডপে ঠাকুর দেখতে বের হন। আলিপুরদুয়ার শহর লাগোয়া মাঝের ডাবরি চা বাগান। সেখানেই বাস করেন এই অসুর সম্প্রদায়ের মানুষেরা। একটা সময় ছিল যখন আলিপুরদুয়ার জেলার মাঝের ডাবরি চা বাগানের এই মানুষেরা দুর্গা পুজো এলে ঘরে মুখ লুকিয়ে রাখতেন। কারণ তারা নিজেদের অসুরের বংশধর বলে মনে করেন। বহু পুরনো আমল থেকেই এই রীতি চলে আসছিল মাঝের ডাবরি চা বাগানে।
এখানে প্রায় ৭০ টি অসুর সম্প্রদায়ের মানুষের বাস। অনেক অসুর সম্প্রদায়ের মানুষ আছেন, যারা ক্যামেরার সামনে আসতে এখনও কুন্ঠা বোধ করেন। বেশিরভাগ অসুর সম্প্রদায়ের পরিবারের সদস্য চা বাগানের শ্রমিকের কাজ করে পরিবার প্রতিপালন করেন। আলিপুরদুয়ার জেলা ছাড়াও ডুয়ার্সের জলপাইগুড়িতেও এই অসুর সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস রয়েছে। পিছিয়ে পড়া এই অনগ্রসর অসুর সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা করে এখনও পর্যন্ত কিছুই করেনি সরকার, বলে তাদের অভিযোগ।
মাঝের ডাবরি চা বাগানের মীরা অসুর বলেন, "আমরা নিজেদের অসুরের বংশধর বলে মনে করি। আমাদের নামের পদবীও অসুর। আমরা আগে দুর্গা পূজায় সামিল হতাম না। কিন্তু এখন আর পারা যায় না। দুর্গা পুজায় চা বাগানে বোনাস হয়। বারতি টাকা হাতে আসে। সকলের সাথে আনন্দ ভাগ করে সামিল হই দুর্গা পূজায়। কে কোন সম্প্রদায় সেসব ধরে থাকলে আর এখন জীবন চলে না।”
অসুর সম্প্রদায়ের এই বিশ্বাসের কোন পৌরানিক ভিত্তি রয়েছে কিনা তাই নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানান জল্পনা রয়েছে। তবে অসুরদের এই দুর্গা পুজায় সামিল না হওয়ার বিষয়টির কোন ঐতিহাসিক দলিল বা প্রমাণ নেই বলে বিশ্বাস করেন বিভিন্ন জনজাতির গবেষকরা।
গবেষক প্রমোদ নাথ বলেন, “ অসুর শুদ্র বংশের মানুষ এটা ঠিক। এরা অনার্য। মূলত দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর মানুষ ডুয়ার্সের অসুর সম্প্রদায়ের মানুষেরা। কিন্তু পৌরাণিক অসুরের সাথে এই অসুরদের কোন যোগাযোগের সুনির্দিষ্ট প্রমান নেই, তবে আর্য অনার্যদের লড়াইয় অবলম্বনে অনেক পৌরাণিক গল্প রচিত হয়েছে। সেভাবেই দুর্গার হাতে বধ হওয়া অনার্য অসুরকে এই বাস্তবের অসুরদের আদিবংশ বলে কোথাও কোথাও বর্ণনা করা হয়ে থাকতে পারে। আর তার ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "অনেক অসুর আগে দুর্গা পূজায় সামিল হতেন না। সেই ভ্রান্তি ভাঙতে সমর্থ্য হয়েছি আমরা। সেই কারনে এখন কিছুটা রীতি ভেঙে অসুররাও দুর্গা পূজায় সামিল হচ্ছেন।"
No comments:
Post a Comment