ট্রোজান হর্স : ইতিহাসের এক বিভীষিকাময় অধ্যায় - pcn page old

Post Top Ad

Post Top Ad

Sunday, 13 June 2021

ট্রোজান হর্স : ইতিহাসের এক বিভীষিকাময় অধ্যায়







ট্রয়ের ঘোড়া বা ট্রয়ের অশ্ব হচ্ছে ট্রয় বা ইলিয়ন নগরের পতনের বিখ্যাত গ্রিক উপকথার সংগে জড়িত কাঠের ঘোড়া। কথিত আছে যে, গ্রিকরা একটি অতিকায় কাঠের ঘোড়া তৈরি করে তার ভিতরে সৈনিকদের লুকিয়ে রেখে ঘোড়াটা ট্রয় নগরের কাছে এনে দাঁড় করায়। ট্রয়বাসীরা ঘোড়াটাকে শহরের ভিতরে নিয়ে আসে; রাত্রে সৈন্যরা ঘোড়ার পেটের ভিতর থেকে বেরিয়ে নগরের দরজা খুলে দেয় এবং গ্রিকরা শহরে প্রবেশ করে তা দখল করে।


ট্রয় আর গ্রিসের মধ্যে সংঘটিত ট্রয়ের যুদ্ধকে ধরা হয় গ্রিক মিথলজির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে।।দেবতা জিউস বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীতে মানুষ বেশি হয়ে গেছে এবং তা কমানোর সময় হয়ে গেছে। এছাড়াও কমানো দরকার মর্ত্যের রমণীদের গর্ভে জন্মানো তার উপদেবতা সন্তানদের সংখ্যা। এরই মধ্যে দুটি ভবিষ্যতবাণী শুনলেন তিনি। প্রথমটি হলো, জিউস যেমন তার বাবা ক্রোনাসকে উৎখাত করেছিলেন, তেমনিভাবে তার এক সন্তানও উৎখাত করবেন তাকে। অপরটি ছিলো, জিউস যে সাগরের দেবী থেটিসের প্রেমে পড়েছিলেন, সে থেটিসের গর্ভে জন্মানো সন্তান যশের দিক দিয়ে তার বাবাকে অতিক্রম করবে। এই ভয়ে জিউস সরে দাড়ালেন, থেটিসের বিয়ে দিলেন পেলাউসের সঙ্গে।

পেলাউস এবং থেটিসের একিলিস নামের ছেলে হয়, যাকে নিয়ে হয় দুইটি ভবিষ্যৎবাণী, প্রথমটি ছিলো হয় সে একঘেয়ে দীর্ঘ জীবন কাটাবে অথবা মহিমান্বিত ক্ষুদ্র জীবন পার করবে যা শেষ হবে যুদ্ধক্ষেত্রে। দ্বিতিয়টি ছিলো এই, একিলিসকে ছাড়া কখনই ট্রয় বিজয় সম্ভব না। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নারী হেলেন ছিলেন স্পার্টার রাজা টিনডারিউসের মেয়ে হেলেন। তাকে বিয়ে করার জন্য সুযোগ্য পাত্ররা রীতিমত লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রাজনৈতিক ঝামেলার কারণে টিনডারিউস কোন সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছিলেন না। এসময় ত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির হন অন্যতম পাণিপ্রার্থী ওডিসাস। বিনিময়ে তিনি টিনডারিউসের ভাইয়ের মেয়ে পেনেলোপকে বিয়ে করার আবেদন জানান। টিনডারিউস রাজি হলেন। ওদিকে মেনেলাউস হেলেনকে বিয়ে করতে আফ্রোদিতির উদ্দেশ্যে বলি দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি করেছিলেন, তা না দেয়ায় তার উপর চটে যান ভালোবাসার দেবী। তিনি প্যারিসকে স্পার্টায় পাঠান হেলেনের মন জয় করতে। সেখানে তাকে স্বাগত জানান স্বয়ং হেলেন। আর এসময়েই হেলেনকে তীর দ্বারা বিদ্ধ করেন এরোস, হেলেন মশগুল হন প্যারিসের প্রেমে, আর দুজন পালিয়ে যায় ট্রয়ে।

স্পার্টায় ফিরে মেনেলাউস দেখেন যে সর্বনাশ হয়েছে, তাই ওডিসাসকে নিয়ে তিনি ট্রয়ে গেলেন হেলেনকে ফেরাতে। কিন্তু ভদ্র ভাষায়কাজ না হওয়ায় মেনেলাউস এবার তার ভাই এগমেননের সহায়তা চাইলেন। সঙ্গে ডাকলেন হেলেনের পাণিপ্রার্থী গ্রিক নেতাদের, তাদের শপথ পূরণ করতে। তবে তাদের দরকার ছিলো একিলিসকে। একিলিসকে নিয়ে সব নেতা এসে উপস্থিত হন অলিস বন্দরে। সেখানে ভবিষ্যদ্বক্তা ক্যালচাস বলেন, ট্রয়ের পতন ঘটবে যুদ্ধের দশম বছরে।

যখন তারা ট্রয়ে পৌছুলো, কেউই নামতে চাচ্ছিলো না। কারণ ভবিষ্যতবাণী মতে, ট্রয়ের মাটিতে পা রাখা প্রথম গ্রীক সবার আগে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। ওডিসাস সিদ্ধান্ত নেয় প্রথমে নামার, কিন্তু নামবার আগে ওডিসাস তার ঢাল আগে মাটিতে ফেলে নেন, যার ফলে তার পরে নামা প্রটেসিলাস হন ট্রয়ে পা দেওয়া ও সবার আগে মৃত্যুবরণ করা গ্রিক, তিনি মারা যান ট্রয়ের রাজপুত্র হেক্টরের হাতে।

গ্রিকরা ট্রয় অবরোধ করে রাখলো নয় বছর, কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হচ্ছিলো না। কারণ, তখনও ট্রয় এশিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারছিলো, যার ফলে তাদের রসদের কোন অভাব হচ্ছিলো না। এ সময় গ্রিক শিবিরে ছড়িয়ে পড়ে অশান্তি আর ক্ষোভ, তারা ফিরে যাওয়ার দাবি করে, কিন্তু একিলিস তাদের আরও কিছুদিন থাকবার জন্য রাজি করায়।

যুদ্ধের দশম বছরে এপোলোর যাজক ক্রিসেস এগমেননের কাছে আসে তার মেয়ে ক্রিসেইসকে ফিরিয়ে নিতে, যাকে উপপত্নী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এগমেনন। এগমেনন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ক্রিসেসের অনুরোধ অবজ্ঞা করলে ক্রিসেস এপোলোর কাছে প্রার্থনা করে সাহায্যের। গ্রিক শিবিরে নেমে আসে মৃত্যুর ছায়া, আকড়ে ধরে প্লেগ। এগমেমনন ক্রিসেইসকে ফিরিয়ে দেন ঠিকই, কিন্তু চেয়ে বসেন একিলিসের সবচেয়ে প্রিয় উপপত্নীকে। এগমেননের হাতে উপপত্নীকে তুলে দিলেও ক্ষিপ্ত একিলিস সাফ জানিয়ে দেন, তিনি যুদ্ধ করবেন না। একিলিস ছাড়া শুরুতে কিছু লড়াইয়ে গ্রিকরা জয়লাভ করলেও, একসময় হারতে শুরু করে।  পিছু হটতে হটতে গ্রিকরা পৌছে যায় সাগরতীরে। ট্রোজানরা গ্রিক জাহাজে আগুন প্রায় ধরিয়েই দিয়েছিলো। উপায় না দেখে একিলিসের প্রিয় বন্ধু প্যাট্রোক্লাস একিলিসের বিশেষ বর্ম আর ঢাল নিয়ে হাজির হয়, তাকে একিলিস ভেবে গ্রিক আর মিরমিডন সৈন্যদের রক্তে বয়ে যায় নতুন উদ্যম, তারা আবার অনুপ্রাণিত হয়ে যুদ্ধ শুরু করে।

কিন্তু বিধিবাম, কিছুক্ষণ পরেই ট্রয়ের যুবরাজ ও বীর যোদ্ধা হেক্টরের হাতে মারা পড়েন প্যাট্রোক্লাস, যদিও হেক্টর তাকে মেরেছিলেন একমাত্র এই কারণে যে, তিনি ভেবেছিলেন প্যাট্রোক্লাসই একিলিস। প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুর সংবাদে ক্ষোভে ফেটে পড়েন একিলিস, আর এরই মধ্যে তার উপপত্নীকে এগমেমনন ফিরিয়ে দেওয়ায় সমঝোতা হয় দুজনের মধ্যে। হেক্টরকে মেরে মৃতদেহ রথের পিছনে বেঁধে ট্রয়ের বিখ্যাত দেয়ালের সামনে দিয়ে ঘুরিয়ে এনে নিয়ে আসেন গ্রিক শিবিরে, যেখানে বীর হেক্টরের স্থান হয় ময়লার স্তুপে। যদিও পরে ট্রয়ের রাজা প্রিয়াম ছেলের মৃতদেহ ফিরিয়ে দেয়ার জন্য একিলিসের কাছে আবেদন জানান, একিলিস মানা করতে পারেননি। একিলিসও পরে মারা যান প্যারিসের ছোড়া তীরে, যেটিকে একিলিসের গোড়ালিতে আঘাত হানিয়েছিলেন স্বয়ং এপোলো।

কোনভাবেই যখন ট্রয় জয় করা যাচ্ছিলো না, তখন ওডিসাসের মাথায় আসে এক দারুণ বুদ্ধি, যা দিয়ে চিরতরের মত এই যুদ্ধ এবং ট্রয় শেষ করা যাবে। গ্রিক ইঞ্জিনিয়ারদের তিনি দায়িত্ব দেন একটি ফাপা ঘোড়া নির্মাণের আর সেই ফাপা জায়গায় লুকিয়ে থাকে ওডিসাস এবং আরও গ্রিক সৈন্য। এরপর তারা সেটিকে রেখে দেয় ট্রয়ের মূল ফটকের সামনে। কিছু গ্রিক জাহাজে চড়ার আগে জানায়, এই ঘোড়া  বিদায় নেবার সময় ট্রোজানদের জন্য একটি সামান্য উপহার। ট্রোজানরা খুশিমনে এই উপহার গ্রহণ করে নিয়ে আসে শহরের ভিতরে। আর সারাদিন শহরজুড়ে চলে যুদ্ধজয়ের আনন্দোল্লাস। উৎসব শেষে যখন সারা শহর ঘুমিয়ে পড়ে তখন ঘোড়ার পেট থেকে বেরিয়ে আসে গ্রিকরা, শুরু করে শহরজুড়ে হত্যার তাণ্ডব। পতন হয় ট্রয়ের, গ্রিকরা পুরো শহর জ্বালিয়ে দেয়, ধ্বংস করে দেবতাদের উপাসনালয়, যা তাদের ভাগ্যে ডেকে আনে চরম দুর্ভোগ। অধিকাংশ গ্রিকই আর বাড়ি ফিরতে পারেননি।

ট্রয়ের যুদ্ধ ছিলো জিউসের এক মহাপরিকল্পনা, যা সফল করে তিনি একই সঙ্গে পৃথিবীর অতিরিক্ত জনসংখ্যা এবং পৃথিবীতে থাকা বহু উপদেবতা ও বীরদের সংখ্যা কমিয়ে নিয়ে আসেন, আর অনেকের মতে এই যুদ্ধের পরই শুরু লৌহযুগ। আর এই যুদ্ধের পর থেকেই ‘ট্রোজান হর্স’ বা ট্রয়ের ঘোড়া হয়ে গেছে এক নিরীহ ঘাতকের প্রতিশব্দ, এবং ‘একিলিস হিল’ মানুষের দুর্বল জায়গার, এই যুদ্ধ এভাবেই বেচে আছে মানুষের মাঝে।

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad