কাঁদলে কেন বের হয় চোখের জল! - pcn page old

Post Top Ad

Post Top Ad

Thursday, 26 March 2020

কাঁদলে কেন বের হয় চোখের জল!



ছোটবেলায় বাবা মায়ের কাছে আমাদের আবদারের শেষ ছিলকাঁ না, এটা চাই, ওটা চাই লেগেই থাকতো। যদি আকাঙ্ক্ষিত বস্তু না পেতাম, শুরু করে দিতাম কান্নাকাটি। জন্মের পর থেকেই মানুষের সেই যে কাঁদার শুরু হয়েছে, সময়ের প্রয়োজনে বড় হওয়ার পরও বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন সময়ে এখনও মানুষ কাঁদে।

আর যখন আমরা কাঁদি চোখ দিয়ে জলের স্রোত বয়ে যায়। কিন্তু আমরা কি জানি কেন আবেগ, দুঃখ, হতাশা আর আনন্দে আমাদের চোখ দিয়ে জল বের হয়? এর উৎস-ই বা কোথায়? চলুন জানা যাক।

কান্না একটি সহজাত ব্যাপার। গবেষণায় জানা যায় যে,  শুধুমাত্র মানুষ-ই নয়, প্রাণিজগতের আরও কয়েকটি সদস্যের কাঁদার ক্ষমতা আছে। তবে আবেগে কাঁদার বৈশিষ্ট্যটি মানুষের জন্য মৌলিক। মানুষ কেবল কষ্ট পেলেই কাঁদে না, সে আনন্দে কাঁদতে পারে, হতাশায় কাঁদতে পারে।

আমরা কেন কাঁদি গবেষকরা এখনও তার সঠিক কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারেন নি। তবে কিছু তত্ত্বগত ব্যাখ্যা অবশ্য আছে। কোনও কোনও বিজ্ঞানী মনে করেন যে, মানুষ তার শারীরিক ও মানসিক ব্যাথা প্রকাশের জন্য কাঁদে। তবে পিটাসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট ডক্টরেট লরেন বিলস্মা (Lauren Bylsma) বলেন, “মানুষ নিজের আবেগময় মুহূর্তে পাশের মানুষটির সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে কাঁদে।” যেমন বাচ্চারা মায়ের মনোযোগের উদ্দেশ্যে কাঁদে।

অশ্রু সাধারণত অক্ষিগোলকের বাইরের উপরের অংশে অবস্থিত ল্যাক্রিমাল গ্রন্থি (Lacrimal Gland) থেকে উৎপন্ন হয়। গুয়েলফ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক মার্ক ফেন্সকে (Mark Fenske) বলেন যে, মস্তিষ্কের আবেগপ্রবণ অঞ্চল, হাইপোথ্যালামাস (Hypothalamus) ও ব্যাসাল গ্যাংগিলার (Basal Gangila) সাথে ব্রেইন্সটেম-এর (Brainstem) ল্যাক্রিমাল নিউক্লিয়াস যুক্ত। যখন আবেগ (যেমন ব্যাথা বা আনন্দ) অনুভূত হয় তখন ল্যাক্রিমাল অশ্রু উৎপাদন করে।

উল্লেখ্য ল্যাক্রিমাল কেবল আবেগের ফলেই অশ্রু উৎপাদন করে না। ল্যাক্রিমালকে আমরা একপ্রকার স্বয়ংক্রিয় জল উৎপাদন ও সরবরাহকারী হিসেবে গণ্য করতে পারি। কারণ, প্রতি সেকেণ্ডেই ল্যাক্রিমাল গ্রন্থি থেকে অশ্রু উৎপাদিত হয়, যা প্রোটিনসমৃদ্ধ ও ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী (Antibacterial)।

উৎপাদিত অশ্রু অক্ষিগোলক ও অক্ষিপটের মাঝে পিচ্ছিল স্তরের সৃষ্টি করে ফলে আমরা পলক ফেলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। মাইকেল ট্রিম্বেল (Michael Trimble) বলেন , “অশ্রু অক্ষিগোলককে আর্দ্র রাখতে প্রয়োজনীয়। এটি প্রোটিনযুক্ত এবং চোখকে সুরক্ষিত রাখতে প্রয়োজনীয় উপাদান ধারণ করে এবং সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে।”

ল্যাক্রিমালে যখন অতিরিক্ত অশ্রু উৎপাদিত হয় তখন এই অতিরিক্ত অংশ নাসারন্ধ্রের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে বাস্তবে ‘চোখের জল নাকের জল’ এক হয়ে যাওয়া ব্যাপারটা সত্য। তাদের উৎপত্তিস্থল এক, কেবল পথ আলাদা। নাকের ভেতর দিয়ে জল প্রবাহের এই ঘটনাকে বিজ্ঞানীরা নাকের জন্যে ভালো বলে মনে করেন। তবে অতিরিক্ত কান্নার ফলে মাথা ব্যাথা হতে পারে।

এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কোনও কোনও গবেষক মনে করেন যে অতিরিক্ত অশ্রু উৎপাদনের ফলে ল্যাক্রিমালে জলশুন্যতা (Dehydration) হয়ে থাকে, যার ফলে মাথাব্যাথা হয়। আবার অনেকে মনে করেন যে অতিরিক্ত কান্নার ফলে পেশীগুলো কিছু সময়ের জন্য দৃঢ় হয়ে যায় এবং মাথাব্যাথা অনুভূত হয়।

জৈবরাসায়নিকভাবে অশ্রুর উপাদান প্রধানত তিনটি; প্রোটিন, লবণ এবং কয়েক প্রকার হরমোন, যা আমাদের লালা (Saliva)-র সদৃশ। চোখের জলকে সাধারণ দৃষ্টিতে পার্থক্য করা না গেলেও কাজের ধরণ অনুযায়ী এটি তিন প্রকারঃ

(১) মৌলিক অশ্রু (Basal Tear) : ল্যাক্রিমাল থেকে এর উৎপাদন বিরতিহীনভাবে চলে। এটি অক্ষিগোলককে পিচ্ছিল করে, পুষ্টি যোগায় এবং রক্ষা করে।

(২) প্রতিরোধী অশ্রু (Reflex Tear) : বহিরাগত বস্তু যেমন বাতাস, ধোঁয়া, ধূলাবালি অথবা তীব্র আলো চোখে প্রবেশের ফলে এই প্রকার অশ্রু উৎপন্ন হয় এবং চোখকে রক্ষা করে।

(৩) আবেগময় অশ্রু (Emotional Tear) : আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের উদ্দেশ্যে এই প্রকার অশ্রুর উৎপত্তি হয় এবং চোখের বাইরে ঝরতে থাকে।

তিনধরণের অশ্রুই একই উৎস থেকে উৎপন্ন হলেও তাদের রাসায়নিক উপাদানের অনুপাতে তারতম্য দেখা যায়। যেমন, আবেগময় অশ্রুতে প্রোটিনের মাত্রা বেশি থাকে। এছাড়া এতে লিউসিন (Leucine) নামক প্রাকৃতিক ব্যাথানাশক, এনকেফ্যালিনও (Enkephalin) পাওয়া যায় এবং ধারণা করা হয় যে এই উপাদানগুলোর জন্যই কাঁদার পর মানসিকভাবে হালকা অনুভূত হয়।

একজন স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের ল্যাক্রিমাল গ্রন্থিতে গড়ে প্রতিদিন ১০ আউন্স এবং প্রতিবছর ৩০ গ্যালনের (১ গ্যালন = ৪.৪৫৩৪ লিটার) মত অশ্রু উৎপাদিত হয়। তবে লিঙ্গভেদে এর পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। স্বাভাবিকভাবে একজন মহিলা একজন পুরুষের থেকে বেশি কাঁদে।

গবেষকদের ধারণা অনুযায়ী মহিলাদের কান্নার মাত্রা গড়ে প্রতিমাসে ৫.৩ গুণ এবং প্রত্যেকবারের গড় সময় ৬ মিনিট, যেখানে পুরুষের ক্ষেত্রে এই পরিমাণ গড়ে প্রতিমাসে ১.৪ গুণ এবং সর্বোচ্চ ২ মিনিট। মাইক্রোস্কোপের নিচে পুরুষের অশ্রুগ্রন্থির কোষকে মহিলাদের অশ্রুগ্রন্থির কোষের থেকে বড় দেখা যায়। যার ফলে মহিলাদের অশ্রু খুব দ্রুত তাদের গাল বেয়ে নেমে যায়, কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে জলের ধারা কিছুটা পাইপের আকার ধারণ করে ও ঝরে যেতে সময় বেশি নেয়।

বয়স বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে মানুষের শারীরিক অনেক পরিবর্তন হয়। ছোট থেকে বড় হওয়া, তারপর বার্ধক্য, চামড়ায় ভাঁজ, দূর্বলতা, চুলে পাক ধরা, চুল পড়ে যাওয়া সহ আরও অনেক পরিবর্তন। কিন্তু একমাত্র অক্ষিগোলকের আয়তন এবং চোখের জল উৎপাদন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চলে।

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad