গ্রীষ্মকালে অনেকেই পাখিদের জন্য জল
রাখেন জানলায়, বারান্দায়, ছাদে। দিনভর ওড়ার ফাঁকে কখনও সখনও সেই জলে এসে ডানা ভেজায়, গলা ভেজায়। তীব্র দাবদাহে প্রকৃতির এই ছোট্ট প্রাণগুলো একটু জুড়োয়, মানুষের বদান্যতায়। কিন্তু এই সহজ কাজটি অনেকেই করলেও, অনেকেই আবার করেন না। করে উঠতে পারেন না। তাঁদেরই এই করার ইচ্ছেকে আর একটু ধাক্কা দিতে একটানা পরিশ্রম
করে চলেছেন ৭০ বছরের মানুষটি। একা হাতে তিনি বানিয়েছেন ১০ হাজারটি মাটির পাত্র, যা বিনি পয়সায় বিতরণ করছেন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষদের মধ্যে। যাতে তাঁরা পাখির জন্য জলের জোগান দিতে পারেন।
এর্নাকুলামের মুপ্পাথড়ামের বাসিন্দা
শ্রীমান নারায়ণনকে সকলে লটারি ব্যবসায়ী বলেই চেনেন। তবে তাঁর আরও একটা পরিচয়
আছে। অবসর সময়ে লেখালেখি করেন তিনি। বই লিখে বেশ কিছু পুরস্কারও পেয়েছেন বৃদ্ধ ও প্রাজ্ঞ মানুষটি। তবে এ সব কিছু বাদ দিয়ে ইদানীং তিনি সব চেয়ে বেশি চিন্তিত, প্রকৃতি নিয়ে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে। প্রতিনিয়ত পৃথিবীর এই ক্ষয়
তাঁকে দুশ্চিন্তিত করছে। ব্যথিত করছে। রুখে দাঁড়ানোর জন্য বলছে তাঁর বিবেক। আর সে জন্যই ব্যবসা ছেড়ে, লেখালেখি ছেড়ে, এবার তিনি মাটিকে আশ্রয় করেছেন। নিজেই কিনেছেন চাক, শিখেছেন কাজ। কিনেছেন মাটি। একা হাতে একের পর এক পাত্র বানাচ্ছেন মাটি দিয়ে। চওড়া মুখের, বড় আয়তনের। যাতে পাখিরা সহজেই এসে স্নান সারতে পারে সে পাত্রের জলে, গ্রীষ্মের দুপুরে জল খেয়ে শীতল হতে পারে। আর এভাবে ১০ হাজারটি পাত্র তৈরি করতে তাঁর খরচ হয়েছে মোট ছ’লক্ষ টাকা। সে পাত্র বিনামূল্যে বিতরণ করছেন তিনি।
শ্রীমান বলছিলেন, “খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে গ্রীষ্মের চেহারা। নদীনালা শুকিয়ে যাচ্ছে সর্বত্র। পাখিদের জল খাওয়ার জায়গা নেই কোথাও। গ্রীষ্মে পর্যাপ্ত জল না
খেলে শুধু মানুষ নয়, পশুপাখিও অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডিহাইড্রেশনে মারা যায়
অনেকে। কিন্তু এই রকম একটা মাটির পাত্রে সারা দিন জল ভরে রাখলে, কম করে শ’খানেক পাখি জল খেতে পারবে।” লেখক বা ব্যবসায়ীর চেয়েও
তাঁর প্রকৃতিপ্রেমের পরিচয়ই আপাতত ছড়িয়ে পড়ছে এর্নাকুলামের নানা প্রান্তে। কারণ তাঁর একা হাতে বানানো ১০ হাজার পাত্রের মধ্যে ন’হাজারটিই বিলি হয়ে গিয়েছে
মানুষের মধ্যে। আবাসনে, অফিসে, স্কুলে, ক্লাবে– বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে পাত্রগুলি। শ্রীমান তাঁর এই প্রোজেক্টের
নাম দিয়েছেন, ‘জীব জলথিনু ওরু মানু পাত্রম’। যার অর্থ, জীবনদায়ী জলের জন্য একটি
মাটির পাত্র।
গত বছরেই প্রথম এই কাজটির কথা ভাবেন
শ্রীমান। শুরুও করেন। কিন্তু প্রস্তুতি না থাকায় বেশি দূর এগোতে পারেননি। গত বছরের ভাবনা মাথায় নিয়েই
এ বছর আগে থেকে উঠে-পড়ে লাগেন তিনি। সফলও হন। বললেন, “অনেক মানুষ উৎসাহ দেখাচ্ছেন। দশ হাজারটা পাত্রই প্রায় শেষ হতে চলল। আরও বানাতে হবে।” কিন্তু শুধু পাখিকে জল খাওয়ানোর জন্য ছ’লক্ষ টাকা খরচ করলেন একা হাতে? এ কথার উত্তরে শ্রীমান বললেন, “আমি তিন কন্যাসন্তানের বাবা। বাবা হিসেবে সব দায়িত্ব
পালন করেছি। ওরা বড় হয়ে গেছে, সুন্দর একটা জীবন পেয়েছে। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সুন্দর জীবনের ব্যবস্থা করাও
তো আমাদেরই কর্তব্য। ভবিষ্যতের জন্য টাকা জমানোর চেয়ে ভবিষ্যৎকে সুন্দর করার চেষ্টা করাই কি এই মুহূর্তে
বেশি জরুরি নয়? প্রকৃতি ধ্বংস হয়ে গেলে
ভবিষ্যতের জন্য জমানো টাকা দিয়ে আর কী হবে? তাই লটারির ব্যবসা চলছে ছোটো করে। যেটুকু দরকার আমার চলে যায়। বাকিটা প্রকৃতির মঙ্গলের
জন্যই উৎসর্গ করতে চাই আমি।” ৩০ বছর আগে স্ত্রীকে হারিয়েছেন তিনি। তার পর থেকেই নানা রকম
কাজে নিজেকে নিযুক্ত রেখেছেন। লেখালেখি তার অন্যতম ছিল। শেষ কয়েক বছরে সেই জায়গা
নিয়েছে, প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা। জানা গেল, গত বছরেই ৫০ হাজার চারাগাছ
বিনামূল্যে বিলি করেছেন তিনি। খরচ করেছিলেন ১৫ লক্ষ টাকা। “তার আগে আমি নিজের উদ্যোগে
এর্নাকুলামের মুপ্পাথড়ামে হাজার দশের গাছ পুঁতেছি নিজের হাতে। বিভিন্ন মানুষের কাছে গিয়ে তাঁদের কাছে জমি ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছি, গাছ লাগাব বলে। ফলের গাছ। যাতে জমির মালিকেরাও সেই গাছের ফল থেকে উপকৃত হন। অনেকেই আমার পাশে থেকেছেন। তবে প্রত্যেককে অনুরোধ করেছি, এক একটা জমিতে অন্তত একটা গাছের ফল যেন পাড়া না হয়, পাখিদের খাওয়ার জন্য রেখে দেওয়া হয়।”– বললেন শ্রীমান।
এ ভাবেই একা হাতে লড়াই করছেন বৃদ্ধ। না আছে তাঁর কোনও সংগঠন, না আছে কোনও বড় সংস্থার ছত্রচ্ছায়া। আছে কেবল একবুক ভালবাসা। প্রকৃতির জন্য, পশুপাখির জন্য। বৃদ্ধ মানুষটি স্বপ্ন দেখেন, এক দিন প্রতিটি মানুষ প্রকৃতির জন্য কিছু না কিছু করবে। তাঁর সীমিত ক্ষমতায় বাঁধা পড়বে না প্রকৃতি রক্ষার এই উদ্যোগ।
শ্রীমান আশা করেন, প্রকৃতি মা যেমন আজন্ম জড়িয়ে রাখেন প্রতিটি মানুষকে, মানুষও তেমনই এক দিন আঁকড়ে ধরবে মৃতপ্রায় প্রকৃতিকে। শুশ্রূষা করবে তার।

No comments:
Post a Comment