কালীগঞ্জের ভট্টাচার্য বাড়ির শচী দেবীর কাহিনী গাঁয়ে কাঁটা ধরাবে আপনারও - pcn page old

Post Top Ad

Post Top Ad

Wednesday, 3 November 2021

কালীগঞ্জের ভট্টাচার্য বাড়ির শচী দেবীর কাহিনী গাঁয়ে কাঁটা ধরাবে আপনারও


প্রদীপ ভট্টাচার্য, প্রেসকার্ড নিউজ: নদীয়া জেলার অন্তর্গত কালীগঞ্জ ব্লকের হরিনাথপুর গ্রামের ভট্টাচার্য বাড়ীতে প্রতিবারের মতো এবারেও কালী মায়ের পুজো অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে করোনা বিধি মেনে এবারে মূর্তি পুজো অনুষ্ঠিত হচ্ছেনা। হচ্ছে ঘটে ও পটে পুজো। তবে অন্যান্য রীতি ও অনুষ্ঠান একই থাকছে। দেবী এখানে 'বুড়ো মা' নামে পরিচিতা। পুজোর সূচনা হয় সম্ভবত ১৭৪০ থেকে ১৭৫০ সালের মধ্যে কোনও এক সময়।


কথিত আছে অষ্টাদশ শতকের মাঝে দেবীদাস ভট্টাচার্য নামে একজন বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্গত রাজশাহী জেলার নাটোর মহকুমার মাঝেরগ্রামের পৈত্রিক বাসস্থান ছেড়ে নদীয়ার কালীগঞ্জের জুড়ানপুর গ্রামের নিকট শ্রীরামপুরে আসেন।  জুড়ানপুরে দেবী দুর্গার ধাতব মূতি, পঞ্চমুন্ডির আসন ও ক্রোধীশ ভৈরবের মন্দির রয়েছে। শোনা যায়, দেবীদাস ভট্টাচার্যকে পুণ্যলাভের উদ্দেশ্যে নাটোরের রানী ভবানী বসবাস করার জন্য ব্রহ্মোত্তর নিষ্কর জমি প্রদান করেন। 


দেবীদাসের সঙ্গে থাকতেন তার সহধর্মিণী ও পুত্র নৃসিংহ। নৃসিংহর জন্মের প্রায় ১২ বছর পরে ওই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন দেবীদাসের কনিষ্ঠ পুত্র রাজারাম সিদ্ধান্ত। রাজারামের পাঁচ বছর বয়সে মাতৃবিয়োগ ও আট বছর বয়সে পিতৃবিয়োগ হয়। কথিত আছে যে, দেবীদাস ভট্টাচার্যের পুত্র রাজারাম সিদ্ধান্ত নদীয়া জেলার কালীগঞ্জের জুড়ানপুরের কাছে  শ্রীরামপুর গ্রাম সংলগ্ন শ্মশানঘাটে মাতৃসাধনায় রত ছিলেন। তিনি কামনা করেছিলেন সর্বশক্তিমান জগন্মাতাকে তার স্ত্রী রূপে লাভ করতে। সাধনায় তৃপ্ত দেবী আদ্যাশক্তি রাজারামকে বলেছিলেন যে, "সবসময় মনে রাখবি আমি সাধারণ মানুষ নই। যে মুহূর্তে তোর মনে হবে যে আমি সাধারণ কেউ, সেই  মুহূর্ত থেকেই আমি আর তোর বাড়ি থাকবো না"। রাজারাম দেবীর এই প্রস্তাবে সম্মত হন। এদিকে রাজারাম স্বপ্নাদেশ পান যে, মুর্শিদাবাদে বেলডাঙার কাছে  ভাবতা স্টেশন সংলগ্ন  মহুলা গ্রামে অবিলম্বন সরস্বতীর একটি বিবাহযোগ্যা কন্যা আছে, নাম শচী দেবী। তার সাথেই পরবর্তীকালে রাজারামের বিবাহ স্থির হয়। 


এরপর কথিত আছে , বৌভাতের দিন অতিথিদের জন্য পঞ্চব্যঞ্জন পরিবেশনের সময় হঠাৎ নববধূর মাথার ঘোমটা সরে যায়। তখন লজ্জা নিবারণের জন্য শচীদেবীর পিঠের দিক থেকে আরও দুটি হাত বেরিয়ে এসে মাথার ঘোমটা তুলে দেয়। এইরূপ আশ্চর্যজনক ঘটনা দেখে আমন্ত্রিত ব্রাহ্মনরা বিস্ময়ে ও শঙ্কায় হতবাক হয়ে যান। এই ঘটনায় চারদিকে হুলুস্থূল পড়ে যায়। কিছুক্ষণ পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে দেখা যায় যে, শচী দেবী বাড়িতে নেই। তাকে আশেপাশে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। এদিকে দেবীকে খুঁজতে রাজারাম সিদ্ধান্ত তখন তার পিছু নেন। পথে এক মৎস্য বিক্রেতা মহিলার সঙ্গে শচী দেবীর হঠাৎই সাক্ষাৎ হয়ে গেলে দেবী সেই মহিলাকে বলেন, "তুমি আমাকে দেখেছ এ কথা যেন কাউকে বলবে না।" কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই শচী দেবীকে খুঁজতে থাকা  রাজারামের সাথে ওই মহিলার দেখা হয় এবং তিনি দেবীর নির্দেশ না মেনে তাকে দেবীর গমনের সব কিছু জানিয়ে দেন। পরক্ষনেই ওই মহিলা  রক্তবমি করে মারা যান। এরপর রাজারামের আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়না। 


এদিকে সাধক রাজারামের অগ্রজ, নৃসিংহের পুত্র দিননাথ তর্কালঙ্কারও মায়ের দর্শন পাওয়ার জন্য শ্রীরামপুর গ্রামে দীর্ঘদিন ধরে কঠোর সাধনা করে আসছিলেন। দিননাথের মনের আশা ছিল তার ছোট দাদু (ঠাকুরদার ভাই) সাধক রাজারাম সিদ্ধান্ত যেমন তপস্যার মাধ্যমে শক্তিরূপিণী মাকে পেয়েছিলেন তেমনি তপস্যার মাধ্যমে তিনিও তাকে পাবেন। কঠিন তপস্যার শেষে একদিন দিননাথ নিদ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় মা জগন্মাতার স্বরূপ দর্শন পান এবং তিনি তাকে পুজোর অনুমতি দিয়ে বলেন, "ভক্তির সাথে দীপান্বিতা অমাবস্যার দিন তোকে নিয়ে তোর বংশের আট পুরুষ পর্যন্ত কেউ আমার পুজো করলে আমি এক মুহূর্তের জন্য হলেও দেখা দেবো।" পরবর্তীকালে গঙ্গার ভাঙনে শ্রীরামপুর গ্রামটি তলিয়ে গেলে বংশ পরম্পরায় হরিনাথপুরের এই ভট্টাচার্য বাড়িতে দক্ষিণাকালী রূপে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ মতে মায়ের পুজো স্থানান্তরিত হয়। 


মা দুর্গার বিদায় সন্ধিক্ষণে অর্থাৎ বিজয়া দশমীতে দেবীর আসনে শুদ্ধাচারে মায়ের সাইত ও খড় বাধা হয়। মায়ের চার হাতের এক হাতে থাকে মুণ্ড, এক হাতে খাঁড়া, এক হাত চিৎ করা, আর এক হাত বরাভয় আকৃতি। দেবীর গায়ের রং কালো এবং ভুরু লাল। শিবের বুকের উপর থেকে সওয়া পাঁচ হাত উচ্চতা হয় দেবীর। আদ্যাশক্তি কালীগঞ্জে 'বুড়ো মা' রূপে বিশেষ পরিচিতা। অমাবস্যা তিথিতে দেবীর আরাধনা করা হয়। সারা রাত্রি ব্যাপি ভট্টাচার্য পরিবারের এই পুজোয় পৌরোহিত্য করেন পরিবারের পুরুষ সদস্যরা। 


শচী দেবীর কাহিনীকে স্মরণ রেখে ভট্টাচার্য পরিবারের বৌ ও মেয়েরা অর্থাৎ বাড়ির মহিলা সদস্যরা দেবীর ভোগ রান্না করেন। এই পুজোয় যিনি পৌরোহিত্য করেন তিনি ছাড়া অন্য কেউ অঞ্জলি দিতে পারেন না। যুগ যুগ ধরে দিননাথ তর্কালঙ্কারের সময় থেকে বংশপরম্পরায় এই নিয়ম চলে আসছে। জনৈক মিস্ত্রি পরিবার এই মূর্তি তৈরী করে আসছেন। অন্যসময় তারা কাঠের কাজ করেন। এই সময় পূজোকে লক্ষ্য করে গ্রামের উন্মাদনা চোখে পড়ার মতো। এই উপলক্ষে মেলা বসে। চারদিকে দেখা যায়  আলোর রোশনাই। বর্তমানে 'বুড়ো মা'র পুজোয় বলিপ্রথা সম্পূর্ণ বন্ধ। 


পুজো উপলক্ষে জনসমাগমের কারণে পুলিশের সাহায্যও নিতে হয়। এই পুজো উপলক্ষে পরিবারের সদস্যরা দূর-দূরান্ত থেকে এসে একসঙ্গে মিলিত হন এবং পুজোর আনন্দে মেতে ওঠেন। পরদিন সিঁদুর খেলার পর শোভাযাত্রা সহকারে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে নিকটবর্তী জলাশয়ে মায়ের বিসর্জন অনুষ্ঠিত হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, একবার সঙ্গীত শিল্পী বাপী লাহিড়ীর বাবা অপরেশ লাহিড়ী 'বুড়ো মা' কে নিয়ে একটা ছবি তৈরির পরিকল্পনাও করেছিলেন, কিন্তু পরিবারের অনিচ্ছায় সেটা আর বাস্তবায়িত হয়নি।

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad