বাংলার মানুষের কাছে সত্যিই কি তৃণমূলের বিকল্প হিসাবে বিজেপি নিজেদের তৈরি করতে পেরেছিল ? নাকি তৃণমূল নেতৃত্ব অযথা ভয় পেয়ে প্রশান্ত কিশোরকে বিপুল অর্থ ব্যয় করে বিনিয়োগ করল? আসলে বিজেপি ও তৃণমূলের নিচু তলা আর মানুষের পালস সম্পর্কে সেভাবে দল দুটির নেতৃত্ব অবগত ছিল না। ফলে একদিকে তৃণমূল যেমন ভয় পেয়েছিল, অন্যদিকে বিজেপি নেতৃত্ব স্বপ্ন দেখেছিল। আর এটাকে কাজে লাগিয়ে প্রশান্ত কিশোর নিজেকে রাজনীতির কৌশলগত ঈশ্বর হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করল।
১১ সালে বাম শাসনের বিরুদ্ধে ভোটার সমাজের একাধিক জেনারেশন তৈরি হয়েছিল। যারা ঐক্যবদ্ধ ভাবে বাম সরকার সরাতে উঠেপড়ে লেগেছিল। এমনকি সরকারী কর্মচারী থেকে বেসরকারী ও অসংগঠিত শ্রমিক সংগঠন থেকে হিন্দু ও মুসলিম সমাজের ধর্ম ভিত্তিক ছোটো বড় সমস্ত সংগঠন এবং পুলিশ প্রশাসনের বিরাট অংশ বাম সরকার পতনের জন্য ভূমিকা নিয়েছিল। আর সব থেকে কঠিন এবং বড় কাজটি করেছিল বাংলার সংবাদ মাধ্যম। ভোটারদের বাম বিরোধী ভোট বাক্সে নিয়ে যেতে জনমত তৈরি করেছিল সংবাদ মাধ্যম। ফলে সংগঠন বিহীন তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে জোট করে বাম শাসন সরিয়ে ফেলতে পারে।
১১ সালে পরিবর্তনে পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিল কেন্দ্রীয় বাহিনী আসার আগে। সেসময় বিভিন্ন জেলার বাম ভোট মেশিনারী নেতাদের গ্রেফতার করে ভোট মেশিনারী বাহিনীকে পুলিশ তৃণমূল মুখি হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিল। পরে কেন্দ্রীয় বাহিনী বাংলার মাটিতে আসতেই বাংলার প্রতিটি বুথ এলাকায় রুট মার্চ করিয়ে দেয় পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য পুলিশ।
তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জানতেন পার্টি কমরেডদের সহ্য করছেন না তাদের প্রতিবেশীরাই। আর সমাজের সমস্ত স্তরের উইং সুইপ করেছে। ফলে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নেন।
১১ সালের এসবের কোনও কিছুই ঘটেনি ২১ সালে। স্বাধীন ভারতে বাংলার শাসন প্রথমে দীর্ঘ দিন কংগ্রেস, পরে বাম শাসন করেছে। ফলে বাংলার মানুষের রাজনৈতিক পরম্পরা তৈরি হয়েছে বাকি ভারতের তুলনায় ব্যতিক্রমী ভাবে।
১১ সালে কমপক্ষে পাঁচটি প্রজন্মের ভোটারদের মধ্যে বাম শাসন বিরোধী মানসিকতা তৈরি হয়েছিল দৃঢ় ভাবে। ২১ সালে তৃণমূলের ১০ বছরের শাসনে সেখানে মাত্র দুটি প্রজন্মের মধ্যে তৃণমূল শাসন বিরোধী মানসিকতা তৈরি হয়েছিল।
১১ সালের আগে পঞ্চায়েত থেকে লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের জয় এবং আন্দোলনের ফলে প্রতিটি বুথ স্তরে তৃণমূল যে ভাবে শক্তিশালী হয়েছিল বিজেপি ২১ সালে তা হতে পারেনি। ১১ সালে তৃণমূল এজেন্ট দিতে না পারলেও বুথের বাইরে পাহারাদার বলয়, ভোটারদের বাড়ি থেকে আনা নেওয়ার বলয় এবং পাড়ায় প্রতিরোধের বলয় তৈরি করেছিল, যাদের টার্গেট ছিল শুধু বামকে সরানো। এজন্য তারা দলীয় অর্থের জন্য অপেক্ষা করেনি। নিজেদের সাধ্য প্রয়োগ করেছিল।
২১ সালে বিজেপি সেখানে কেবলই রাস্তায় জয় শ্রীরাম স্লোগান দেওয়া বাহিনী তৈরি করতে পেরেছিল। এই বাহিনী আবার ছিল প্রবল লোভী। এমনকি ১১ সালে তৃণমূলের নেতাদের মধ্যে দলের ফান্ড ঝেড়ে পকেট ভর্তি করার মানসিকতা ছিল না। ২১ সালে বিজেপির নেতা থেকে কর্মী সকলের মধ্যে দলের টাকা আত্মসাৎ করা থেকে কোন্দল মানসিকতা ছিল তুঙ্গে।
২১ সালের নির্বাচনে তৃণমূল বিরোধীতা সমস্ত সংগঠনে ছিল বিক্ষিপ্ত। যদিও ভোটারদের বিরাট অংশ প্রকাশ্যে তৃণমূলের সমালোচনা করেছিল। তবে এই তৃণমূল বিরোধী ভোটারদের সংখ্যা এত বেশি ছিল না যার ফলে তৃণমূল সরকার গড়তে পারবে না। পাশাপাশি সংবাদ মাধ্যমের সাথে বিজেপির সখ্যতা তৈরি হয়নি। উল্টোদিকে বিজেপির হয়ে ১১ সালের ন্যায় সংবাদ মাধ্যমও বিজেপি ময় হয়ে ভোটারদের মধ্যে জনমত তৈরি করেনি জেনে বুঝেই।
১১ সালে তৃণমূলের একটা জেলায় যে সংখ্যায় নেতা তৈরি হয়েছিল বিজেপির গোটা রাজ্যে সম সংখ্যায় রাজনৈতিক এবং জনসংযোগে শিক্ষিত নেতা তৈরি হয়নি প্রজন্ম ভেদে।
১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসে বিজেপি বিরোধী শিবিরের কংগ্রেসের সর্বস্তরের দুর্বলতা আর কোন্দলের কারণে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেশের বাকি আঞ্চলিক দলগুলোকে কলকাতায় ডেকে মহা জোটের ডাক দিয়ে বাংলায় ৪২ এ ৪২ মিশনের ডাক দেয়।
বাম কংগ্রেসের জোটে ভরসা না করা ভোটাররা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জোটে ভরসা করবেন না এই সহজ স্বাভাবিক বিষয়টি তৃণমূল নেতৃত্ব বুঝতে পারেননি। ফলে লোকসভা নির্বাচনের পর ৪২ আসনে তৃণমূল পায় মাত্র ২২ টি। তৃণমূলের এই ব্যর্থতার পর থেকে পঞ্চায়েত, পৌরসভা এবং বিধানসভার জনপ্রতিনিধিরা কার্যত দিশেহারা হয়ে পড়ে।
এরই মাঝে আসে ভোট কুশলী প্রশান্ত কিশোর। চতুর প্রশান্ত কিশোর বাংলার জনবিন্যাস সম্পর্কে আগে থেকেই জানতেন। ১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী করতে গিয়ে বিজেপির হয়ে কাজ করা প্রশান্ত কিশোর বাংলার ভোটারদের নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে শুরুতেই তৃণমূলের সংগঠনে নানা বিষয়ে প্যানিক পিন তৈরি করে রেখে নিজের সংস্থার প্রভাব বিস্তারে সফল।
বিজেপির দিল্লীর নেতৃত্ব বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবেশ এবং ভোটারদের ও দলীয় নেতৃত্ব সম্পর্কে নানা সংস্থার মাধ্যমে খবর পেয়েছিলেন আগে থেকেই। মোদী-শাহের টিম তখন তাদের পরিকল্পনা পাল্টে ফেলেন এমন ভাবে, যা বাংলার কেন দেশের এমনকি বিজেপির দিল্লীর সব নেতারাই বুঝতে পারেননি। রাজনৈতিক সুচতুর বিজ্ঞ অমিত শাহ দিলেন পাল্টা চাল। আর নরেন্দ্র মোদী সেই চালে দিলেন সোহাগা ঢেলে।
জনগনকে ভোট দিতে উৎসাহিত করতে ১৯ সালে সংঘের প্রচারকরা ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে লিফলেট বিলি করলেও বিধানসভা নির্বাচনে তারা চুপ রইলেন, বাংলা মিডিয়ার তৈরি বাঙালি চানক্য মুকুল রায়কে কৃষ্ণনগর উত্তরে বসিয়ে দেওয়া এবং তৃণমূল থেকে আসা নেতাদের পছন্দের লোকদের প্রার্থী করে। এমনকি ভোটের মধ্যে পেট্রোল ডিজেল ও গ্যাসের দাম ধাপে ধাপে বাড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাঁধে সিলিন্ডার তুলে দিয়ে মিছিল করার সুযোগ করে দিলেন।
কেন্দ্রীয় বাহিনী যে ১১ সালের মতন ২১ সালে বাংলার সমস্ত বুথ এলাকায় রুট মার্চ করেনি এবং পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কে সবটাই জানতেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মন্ত্রী অমিত শাহ।
অমিত শাহের টিম বাংলার বিজেপি নেতাদের দুর্নীতি থেকে সমস্ত ধরণের কাজ কর্ম সম্পর্কে জানিয়ে নির্বাচন শুরুর আগেই রিপোর্ট দিয়েছিল। এমনকি খোদ গোয়েন্দা রিপোর্টে উল্লেখ ছিল বিজেপির সমস্ত সাংগঠনিক জেলা সভাপতি ও কমিটির সদস্যদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য। শোনা যায়, রাজ্য কমিটি ও কেন্দ্রের পাঠানো নেতাদের সম্পর্কে গোয়েন্দা রিপোর্ট দেখে চমকে উঠেছিলেন খোদ অমিত শাহ ও নরেন্দ্র মোদী।
শাহ মোদী রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর কৌশল বদলে ফেলে। বিজেপির থিংক ট্যাঙ্কের গোপন বৈঠকে ঠিক হয় চড়া হিন্দুত্বের তাস খেলে ভোট রাজনীতি করবে বাংলায়। তাতে ভোট দু'ভাগ হয়ে যাবে। একটা ভাগ বিজেপি পাবে, আরেকটা ভাগ পাবে তৃণমূল। মুসলিম সমাজের ভোট বিজেপি পায় না, তা সর্বজন বিদিত। পেট্রোল গ্যাসের দাম ধাপে ধাপে বাড়ালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে পাল্লা ভারী হয়ে যাবে। বাম-কংগ্রেস শুন্য হয়ে যাবে বাংলা। এভাবেই ভাষা থেকে ধর্ম ইস্যুতে তাস খেলতে শুরু করল বিজেপি, যা দেখে বহু বিজেপি বলতে শুরু করল নেতৃত্ব ঠিক করছে না কাজটি।
বিজেপি নেতৃত্বের চাতুর্যের রাজনীতির খেলা ধুরন্ধর রাজনীতিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও প্রথম দিকটায় বুঝতে পারেননি, এমন দাবী সূত্রের। সূত্রের আরও দাবী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাতে করে কখনই নিজের সংগঠনের বিশ্বাস রাখতে না পারেন তার পাকাপাকি ব্যবস্থা করে দিয়েছেন প্রশান্ত কিশোর।
বিজেপির একাধিক সূত্রের দাবী, বিজেপিতে ১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে প্রশান্ত কিশোর কাজ আর ২১ সালে তৃণমূলে প্রশান্ত কিশোরের কাজ এক ছিল না। বিজেপির একাধিক নিজস্ব উইং আছে যেটা তৃণমূলের নেই, ফলে প্রশান্ত কিশোরের মত চরিত্র ব্যবহারের সুফলের থেকে কুফলই বেশি। সময়কালে তৃণমূল কংগ্রেস তা বুঝতে পারবে।
এরই মাঝে হঠাৎ প্রচার, প্রশান্ত কিশোর একজন পূর্ণকালীন রাজনীতিবিদ হওয়ার এবং ভারতের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল কংগ্রেস পার্টিতে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন, যা নিয়ে ভারতে মিডিয়া উন্মাদনা তৈরিও হয়েছিল। যদিও তিনি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য নীতীশ কুমারের জনতা দলে সহ-সভাপতি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন এবং নীতীশ কুমারের উত্তরাধিকারী হিসাবে পাটনায় কানাঘুষা বেড়াচ্ছিল । যদিও নীতিশ কুমার তা করেননি এবং কিশোরকে তার দল থেকে বের করে দেন।
আবার তৃণমূলের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা দেখে, রাজনৈতিক মন্তব্যকারীরা কংগ্রেস দলে কিশোরের সম্ভাবনা সম্পর্কে নিশ্চিত নন।
এরই মাঝে প্রশান্ত কিশোরের অন্য পদক্ষেপ আরও আকর্ষণীয়। পিকে এগিয়ে গিয়ে গোয়ার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লুইজিনহো ফ্যালেরিওর সাক্ষ্য অনুযায়ী গোয়ায় কংগ্রেস পার্টি ভেঙে দিলেন, যিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস থেকে তৃণমূল কংগ্রেসে (টিএমসি) পার্টির ব্যাগ এবং লাগেজে স্যুইচ করেছিলেন।
এটি স্মরণ করা যেতে পারে যে প্রশান্ত কিশোর সাম্প্রতিক বাংলার নির্বাচনে টিএমসির প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন যেখানে মমতা ব্যানার্জী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) কে ধাক্কা দিয়েছিলেন এবং পিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলায়।
©সত্যজিৎ চক্রবর্তী।
লেখক : আর প্লাস নিউজের সাংবাদিক
বি দ্র : আর্টিকেলটি লেখকের ব্যক্তিগত মতামত। লেখকের মতামতের সাথে সহমত পোষন করে না প্রেসকার্ড নিউজ।
No comments:
Post a Comment