মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর শালিকাকে ফুটপাত থেকে উদ্ধার করে নেওয়া হল হাসপাতালে, রইল গোটা পর্ব - pcn page old

Post Top Ad

Post Top Ad

Friday, 10 September 2021

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর শালিকাকে ফুটপাত থেকে উদ্ধার করে নেওয়া হল হাসপাতালে, রইল গোটা পর্ব


প্রেসকার্ড নিউজ ডেস্ক: পরনে ধুলো কাঁদা মাখা নোংরা নাইটি। উষ্কখুষ্ক চুলে ডানলপ মোড়ে ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছেন এক বৃদ্ধা। সঙ্গী বলতে কাঁধে একটা ঝুলি। কখনও চায়ের দোকান, কখনও লস্যির দোকান, কখনও বা ফাস্টফুডের দোকানের সামনে বসে পড়ছেন ঝুলি নিয়ে। কিন্তু ব্যবসার জায়গা বলে কথা। তাই ব্যবসায়িক ক্ষতির কথা চিন্তা করে দোকানদাররা মুখ ঝামটা দিয়ে দু চার কথা শুনিয়ে বিদায় করে দিচ্ছেন দোকানের সামনে থেকে। পথচলতি মানুষজনও তাকে দেখে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। পাছে না বিকারগ্রস্ত বৃদ্ধার খপ্পরে পড়তে হয়। অথচ তাঁর পরিচয় জানলে চোখ কপালে উঠবে। আদতে তিনি হলেন এ রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্যর নিজের বোন! অর্থাৎ বুদ্ধদেব বাবুর শ্যালিকা! এমনই দাবী ওই বৃদ্ধা ঈরা বসুর। 


বয়স সত্তরের কোটা ছাড়ালেও তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই। উষ্কখুষ্ক চুল এবং পরনে আলখাল্লা ধুলো - কাঁদা মাখা নাইটি পরে খালি পায়ে ডানলপ মোড়ে পাগলের মতো কখনও রাস্তার একপাশে তো পর মুহূর্তে রাস্তার উল্টোপাশে তিনি ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছেন। সম্বল বলতে কাঁধে একটা ঝুলি। তাতে রয়েছে এদিক ওদিক থেকে পাওয়া দু চারটে জামাকাপড়। মুখে বাংলা ইংরেজি মিশ্রিত কথার ফুলঝুরি। গত প্রায় এক বছর ধরে ডানলপ মোড়ের দোকানদাররা ওই বৃদ্ধাকে নিয়ে এই ছবি দেখতেই অভ্যস্ত। অথচ ওই বৃদ্ধাই যে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর শ্যালিকা, তা তাদের কেউই জানেন না। ডানলপ মোড়ে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশের কর্মীদের কাছেও অজানা। এহেন একজন হাইপ্রোফাইলের এখন ঠিকানা ফুটপাথ। কিন্তু কেউ তাঁর খোঁজ রাখেন না। যদিও তাতে তাঁর কোনও আক্ষেপ নেই। 


অথচ ফুটপাথে থাকা উচ্চশিক্ষিতা এই ঈরা বসুই একসময় খড়দহ প্রিয়নাথ গার্লস হাইস্কুলের জীবনবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষিকা ছিলেন। যথেষ্ট সুনামের সহিত তিনি শিক্ষকতা করেছেন। সেই সময় স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার খড়দহের লিচুবাগানের বাড়িতেই তিনি থাকতেন এবং সেখান থেকেই স্কুলে যাতায়াত করতেন। ২০০৯ সালের ৩১ জানুয়ারি তিনি স্কুলের চাকরি থেকে অবসর নেন। বর্তমান ঠিকানা ডানলপের ফুটপাথ হলেও তার আগের কয়েক বছর শিয়ালদহ স্টেশনের বাইরে ফুটপাথ তাঁর ঠিকানা ছিল বলে নিজেই জানান বৃদ্ধা ঈরা বসু। তবে এখনও স্কুলের বর্তমান শিক্ষিকা থেকে কর্মী এমনকি ছাত্রীরাও তাকে এক নামেই চেনেন এবং জানেন। 


এক শিক্ষিকা আক্ষেপ করে বলেন, 'ওনাকে অনেকবার ছাত্রছাত্রী, এমনকি শিক্ষক সংগঠনের সদস্যরা মিলে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু উনি আসেননি।' নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই স্কুলেরই এক শিক্ষিকা যিনি ঈরা বসুর সময়কাল থেকেই শিক্ষকতা করে আসছেন। তিনি বলেন, 'ওনার অবসরের পর উনি যাতে পেনশনটা ঠিকঠাক পান সেইমতো স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষিকা উদ্যোগ নিলেও পেনশন সংক্রান্ত কাগজপত্র ঈরা দেবী না দেওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি। তবে ওই সময় প্রধান শিক্ষিকার বদান্যতায় পিএফের টাকাটা উনি পেয়েছিলেন। তবে উনি যে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্যর বোন তা তিনি কখনও মুখে প্রকাশ করেননি। আমরা জিজ্ঞাসা করলে উনি এড়িয়ে যেতেন। আবার কখনও নিজেই মুখ ফুটে বলে দিতেন। তবে কখনও ক্ষমতা জাহির করেননি তিনি।' স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষিকা কৃষ্ণকলি চন্দ্র বলেন, 'বিভিন্ন ছাত্রীর মুখে শুনেছি উনি ডানলপ মোড়ে খোলা আকাশের নীচে দিন কাটাচ্ছেন। সেই সংক্রান্ত তাঁর ছবিও আমরা দেখেছি।' 


এদিকে যাকে নিয়ে এতকিছু সেই ঈরা বসু কথায় কথায় স্বীকার করে নেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পর্কে তাঁর জামাইবাবু হন। তাঁর ছাত্র জীবন থেকে শিক্ষকতা জীবন গড়গড়ে বললেও সবশেষে তিনি বলেন, জামাইবাবু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হলেও ওঁনার থেকে কোনও সুবিধা নিইনি। ওঁনার মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া খুবই মুশকিল বর্তমানে। তবে তখন সাহায্য না নিলেও এখন দুমুঠো অন্নের জন্য পথচলতি মানুষ বা ডানলপ মোড়ের ব্যবসায়ীদের দিকেই মুখ চেয়ে তাকিয়ে থাকতে হয় তাকে। যদিও ঈরা দেবী জানিয়েছেন,  তিনি নিজের খাবারের খরচ নিজেই চালান। তিনি স্বচ্ছল পরিবারের মেয়ে। রাস্তার ভিখারি নন !


এই খবর সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হতেই নড়েচড়ে বসে সরকার। উদ্যোগী হয় ইরা দেবীকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠাতে। 


ডানলপের ফুটপাথে পড়ে থাকা বৃদ্ধাকে শেষমেশ উদ্ধার করে বালিগঞ্জের মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল বৃহস্পতিবার। অথচ গত প্রায় এক বছরেরও বেশী সময় ধরে ডানলপ মোড়ের ফুটপাথই ঠিকানা ছিল মানসিক ভারসাম্য হারানো ঈরা বসুর, যিনি সম্পর্কে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর শ্যালিকা। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হয়েছিল 'এই সময়' কাগজেই। তারপরই নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। 


 ডানলপ মোড়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এধরণের একজন মানুষের পড়ে থাকার খবরে কার্যত শোরগোল পড়ে যায়। কাগজে খবর দেখে খড়দহের স্কুলে যেহেতু তিনি শিক্ষকতা করতেন সেহেতু তাকে উদ্ধারে উদ্যোগী হয় খড়দহ পুরসভা। পুরসভার অ্যাম্বুলেন্স ডানলপ মোড়ে পাঠানো হয় তাকে উদ্ধার করে খড়দহ বলরাম হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করানোর জন্য। কিন্তু ততক্ষণে ঈরা বসু নিজেই কাগজে নিজের এহেন খবর দেখে গা ঢাকা দেন। 


ডানলপ মোড়ে কর্তব্যরত এক পুলিশ কর্মীর কথায়, 'ওই বৃদ্ধার মানসিক সমস্যা থাকলেও খবরের কাগজে চোখ বোলানো ওনার রোজের রুটিন ছিল।' তবে এদিন প্রথমে তাকে না পেয়ে ফিরে যায় অ্যাম্বুলেন্স। পরে দুপুরের দিকে ফের ডানলপ মোড়ে অ্যাম্বুলেন্স পাঠায় পুরসভা। খড়দহ পুরসভার এক্সিকিউটিভ অফিসার সুশান্ত মণ্ডল বলেন, 'আমরা খবরটি দেখা মাত্রই অবসরপ্রাপ্ত ওই শিক্ষিকাকে উদ্ধারে উদ্যোগী হয়েছিলাম। কিন্তু প্রথমবার ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয়বার ওঁনার খোঁজ পাই। অ্যাম্বুলেন্সে তুলে বলরাম হাসপাতালে নিয়ে আসার পথে বরানগর থানা থেকে ফোন করে বরানগর থানায় ওনাকে নিয়ে যেতে বলা হয়। সেইমতো আমরা নিয়ে যাই'। 


এদিকে ততক্ষণে বরানগর থানার সামনে হাজির হয়ে যান বালিগঞ্জ লুম্বিনী পার্কের একটি মানসিক হাসপাতালের চিকিৎসক ও আধিকারিকদের একটি টিম। সূত্রের খবর, প্রশাসনিক নির্দেশেই তাঁরা বগরানগর থানায় হাজির হয়ে যান। খড়দহ পুরসভার অ্যাম্বুলেন্সে চেপে ঈরা বসু বরানগর থানায় হাজির হতেই চিকিৎসকরা অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যেই তাঁর প্রাথমিক চিকিৎসা করান। তারপরই তাঁরা ওই অ্যাম্বুলেন্সে করেই লুম্বিনী পার্কের মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যান তাকে। 


জানা গিয়েছে সেখানেই তাকে ভর্তি করানো হয়েছে। কামারহাটির প্রাক্তন বিধায়ক তথা সিপিএম নেতা মানস মুখোপাধ্যায় বলেন, 'ঈরা বসুকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। উনি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর শ্যালিকা, সেটাও জানতাম। তবে সেভাবে আলাপ ছিলনা। খড়দহ, কামারহাটি, পানিহাটির কোনও মিটিংয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এলে ওনাকে মিটিংয়ে দেখতাম। চেয়ারও দেওয়া হত ওনাকে। কিন্তু বুদ্ধ বাবু যে ওনার জামাইবাবু হন, তা কখনও তিনি প্রকাশ করতেন না। ওনার চাকরি জীবনের শেষদিকে চলনে কিছু অস্বাভাবিকতা  ছিল। কিন্তু তাই বলে উনি যে ফুটপাথে পড়ে আছেন এটা আমাদের জানা ছিলনা। আমরা চাই প্রশাসনিক উদ্যোগে ওনার সঠিক চিকিৎসা হোক।' 


এদিকে শেষমেশ ঈরা বসু নামে ওই বৃদ্ধাকে প্রশাসনের উদ্যোগে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ায় ডানলপ মোড়ের কর্তব্যরত পুলিশ থেকে  দোকানদাররা 'এই সময়' কাগজকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের বক্তব্য কাগজে খবরটি প্রকাশিত না হলে ঈরা বসুর মতো এরকম একজন গুণী মানুষের ঠিকানা হয়তো এখনও ফুটপাথই থাকতো।

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad