নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা : কোভিড প্রোটোকল মেনেই কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে দক্ষিণ কলকাতার "ভবানীপুর" বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের শুরু হল। সকাল সাতটা থেকে শুরু হয় ভোট গ্রহণ এবং কোনও বিরতি ছাড়া এটা চলবে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত।
এদিন সকাল থেকে বিভিন্ন ভোট গ্রহণ কেন্দ্র গুলিতে ভোটারদের লাইন চোখে পড়েছে।
এই কেন্দ্রে মোট ভোটারের সংখ্যা ২,০৬,৩৮৯ জন। এর মধ্যে ৯৫,১৪৩ (৪৬ শতাংশ) জন নারী ভোটার। এই কেন্দ্রের প্রায় শতকরা ২০ ভাগ ভোটার মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত, শিখ ও অ-বাঙালি ভাষী হিন্দুর বসবাস প্রায় ৩৪ শতাংশ।
অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে কলকাতা পুলিশের তরফে একাধিক সতর্কতা নেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকেই ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভোটকেন্দ্রের দুইশত মিটারের মধ্যে ১৪৪ ধারা লাগু করা হয়েছে (একসাথে পঁচকজনের বেশি জমায়েত নিষিদ্ধ)। উপনির্বাচনের দিন ৯৭ টি ভোটকেন্দ্রে ২৮৭ টি বুথের প্রতিটিতে থাকছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। এজন্য ১৫ কোম্পানি বাহিনী মোতায়েন করা হচ্ছে।
বুথের বাইরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবেন কলকাতা পুলিশের সদস্যরা। ভোটকেন্দ্রের একশত মিটারের মধ্যে যাতে কোন নিরাপত্তারক্ষীর হাতে বন্ধুক বা অস্ত্র না থাকে- তা নিশ্চিত করতে এক নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। নজর রাখা হচ্ছে বহিরাগতদের ওপরেও। ভবানীপুর কেন্দ্রের অধীন প্রতিটি হোটেল ও গেস্ট হাউজে বহিরাগতদের সন্ধানে অভিযানে নামে পুলিশ।
এবারের উপনির্বাচনে মোট ১২ জন প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারিত হবে এই কেন্দ্রে। তবে প্রধান লড়াই হবে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি, বিজেপি প্রার্থী আইনজীবী প্রিয়াঙ্কা তিব্ৰেওয়াল ও সিপিআইএম প্রার্থী শ্রীজীব বিশ্বাস এর মধ্যে।
যদিও কারও কারও অভিমত, মমতা ব্যানার্জির প্রতিদ্বন্দ্বি একমাত্র তিনি নিজেই।
এই ভবানীপুর কেন্দ্রে বহু নামি ভোটার আছে, যার মধ্যে রয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীর নিজে। এদিন দুপুরে ভবানীপুরের মিত্র ইন্সটিটিউশন ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে ভোট দিতে আসবেন মমতা ব্যানার্জি। তার আগে এদিন সকালে ওই ভোট গ্রহণ কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা একাধিক ভোটার জানান কভিড স্বাস্থ্যবিধি মেনেই ভোট নেওয়া হচ্ছে, নিরাপত্তা ব্যবস্থাও যথেষ্টই ভালো।
এক ভোটার মীনাক্ষী চক্রবর্তী জানান "মমতা ব্যানার্জির জয়ের সম্ভাবনা বেশি বলে জানান এক নারী ভোটার। তার মতে বরাবরই পুর বরাবরই শান্তিপ্রিয় একটি জায়গা, তাই যেই জিতুক কোনওরকম অশান্তি যেন না হয়।
অনিন্দিতা চৌধুরী নামে আরেক নারী ভোটার জানান "ভবানীপুরে মমতা ব্যানার্জিই একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী। ওনার সঙ্গেই ওনার লড়াই হচ্ছে। আমার মনে হয় না, মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে লড়াই করার মত কেউ আছে। অন্যান্য ব্যবস্থাপনা ও খুব সুন্দর।"
এক পুরুষ ভোটার জানান "নিরাপত্তা খুব ভাল ছিল, খুব ভালো ব্যবস্থাপনা। আমি অনেকদিন ধরে ভোট দিচ্ছি মিত্র ইন্সটিটিউশন'এ। মমতা ব্যানার্জিও এখানে ভোট দেন। মমতা ব্যানার্জি এই পাড়ারই মেয়ে, আমি চাই সঠিক লোক নির্বাচিত হোক।
রাকেশ প্রসাদ নামে এক ভোটার জানান "এখানে মূল লড়াইটা হতে পারে তৃণমূল এবং বিজিপির মধ্যে। বাকিরা একেবারেই প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কার জেতার সম্ভাবনা আছে সেই প্রশ্ন যথেষ্ট কুশলী উত্তর " এখনই বলা অসম্ভব।"
এবারের এই উপনির্বাচন মমতা ব্যানার্জির কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে টিকে থাকতে হলে এই এই নির্বাচনে তাকে জিততেই হবে।
দক্ষিণ কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ‘ভবানীপুর’ মমতার নিজের এলাকা। তিনি কেবলমাত্র এই বিধানসভা কেন্দ্রের বাসিন্দাই নন, ২০১১ ও ২০১৬ সালের নির্বাচনেও এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়ে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন মমতা।
করোনার আবহেই গত মার্চ-এপ্রিল মাসে রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনে নিজের পুরনো কেন্দ্র ‘ভবানীপুর’ ছেড়ে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ‘নন্দীগ্রাম’ কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মমতা। কিন্তু সেই নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারীর কাছে ১৯৫৬ ভোটে পরাজিত হন মমতা। যদিও তার দল তৃণমূল কংগ্রেস ২৯২ টি আসনের মধ্যে ২১৩ টি আসন পেয়ে তৃতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় আসে। যদিও মমতার ছেড়ে যাওয়া ভবানীপুর কেন্দ্র থেকে বিরাট ব্যবধানে জয়ী হন সিনিয়র তৃণমূল নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। তিনি হারান বিজেপি প্রার্থী অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষকে।
এরপর গত ৫ মে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন মমতা। ১০ মে শপথ নেয় তার মন্ত্রিসভার বাকী ৪৩ জন সদস্য। কৃষি মন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন শোভনদেব। নিয়ম অনুযায়ী কোন মন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই তাকে রাজ্যের কোনও না কোনও বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জিতে আসতে হয়। সেক্ষেত্রে জল্পনা চলছিল মমতা কি তবে নিজের পুরনো কেন্দ্র ভবানীপুর থেকেই ফের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন? এরই মধ্যে মমতার রাস্তা পরিস্কার করতে গত মে মাসেই ভবানীপুর কেন্দ্র থেকে ইস্তফা দেন শোভনদেব। ফলে ওই কেন্দ্রে উপনির্বাচন জরুরী হয়ে পড়ে।
এর আগে ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে রাজ্যে যখন প্রথমবারের জন্য তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে, সেসময় মমতা ছিলেন লোকসভার সাংসদ। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথগ্রহণের পরই উপনির্বাচনে এই ভবানীপুর কেন্দ্রে প্রার্থী হয়েছিলেন মমতা। সেবার সিপিআইএম প্রার্থী অধ্যাপিকা নন্দিনী মুখার্জিকে ৫৪,২১৩ ভোটে পরাজিত করেছিলেন মমতা।এরপর ২০১৬ সালের বিধানসভার নির্বাচনেও ভবানীপুর কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছিল মমতা ব্যনার্জি। সেবছর কংগ্রেসের প্রার্থী দীপা মুন্সিকে ২৫,৩০১ ভোটে হারান মমতা।
কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভার নির্বাচনের নিরিখে ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের লিড ছিল মাত্র ৩৫০০ ভোট। আর এই আশঙ্কা থেকেই একুশের বিধানসভা নির্বাচনে ভবানীপুরের বদলে নন্দীগ্রামে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেন মমতা। কিন্তু ভবানীপুরে শোভনদেব জিতলেও পরাজয়ের স্বাদ নিয়ে ফিরতে হয়েছিল মমতাকে, তাই ফের নিজের পুরনো কেন্দ্রেই ফেরেন মমতা। সেক্ষেত্রে এই উপনির্বাচন মমতার কাছে প্রেস্টিজ ফাইট। কারণ তার প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বিও যথেষ্ট কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেলতে পারে।
অন্যদিকে বৃহস্পতিবার ‘ভবানীপুর’এর সাথেই মুর্শিদাবাদ জেলার সামসেরগঞ্জ ও জঙ্গিপুর বিধানসভা কেন্দ্র দুইটিতেও সাধারণ নির্বাচন শুরু হয়েছে।
সামসেরগঞ্জে তৃণমূলের প্রার্থী আমিরুল ইসলাম, বিজেপির মিলন ঘোষ, সিপিআইএম প্রার্থী মো. মোদাসসার হোসেন। আর জঙ্গিপুরে তৃণমূলের প্রার্থী জাকির হোসেন, বিজেপি প্রার্থী সুজিত দাস, বাম প্রার্থী জানে আলম মিলন।
পূর্ব নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী গত ২৬ এপ্রিল সপ্তম দফার নির্বাচনের আগে করোনায় ওই দুই কেন্দ্রেরই ‘সংযুক্ত মোর্চা’র প্রার্থীর মৃত্যু হওয়ায় সেখানে ভোট স্থগিত রাখা হয়েছিল। আগামী ৩ অক্টোবর তিনটি কেন্দ্রেই ভোটগণনা।
No comments:
Post a Comment