নিজস্ব প্রতিবেদক: কাজী নজরুল ইসলাম-এর সাম্যবাদের চিন্তা ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বে। ‘সাম্য, সম্প্রতির কবি নজরুল, তাঁর হৃদয় মাধুর্য দিয়ে সকল শ্রেণি বৈষম্য দূর করতে চেয়েছিলেন। জাত ধর্ম হৃদয়ের প্রেম ধর্ম৷ যে প্রেম মানুষের কল্যাণে উৎসারিত হয়ে উঠে। শুধু লেখনীর দ্বারা নয়, নিজের জীবনের সব রকম ঝুঁকি নিয়ে ঐক্যের আশায় আশাবাদী নজরুল। তাঁর ব্যক্তিজীবনে এই ভাবনার প্রয়োগ করেছিলেন তাঁর বিবাহের ক্ষেত্রে, পুত্রদের ক্ষেত্রেও। তাঁর পরিবারের কনিষ্ঠ পুত্রবধূ হিসেবে আমি এই সত্য উপলব্ধি করেছি।’
২৪ ও ২৫ মে, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২২তম জন্মজয়ন্তীতে প্রথমবারে মতো অনলাইনে ‘সাম্যবাদে নজরুল’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংগঠন মুক্ত আসরের আয়োজন করে ‘আমিই নজরুল আন্তর্জাতিক নজরুল উৎসব’। এই উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উদ্বোধক হিসেবে বক্তব্য দেন কবির কনিষ্ঠ পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী।
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনর সভাপতিত্বে দুইদিন ব্যাপী ‘আমিই নজরুল আন্তর্জাতিক নজরুল উৎসব’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলা একাডেমির সভাপতি, বিশিষ্ট নজরুল গবেষক, জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম, বিশেষ অতিথি ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. তপোধীর ভট্টাচার্য,নজরুল নাতনি খিলখিল কাজী, ভারতের গবেষক ও লেখক অধ্যাপক সুমিতা চক্রবর্তী, কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল, বাংলাদেশ ইতিহাস অলিম্পিয়াড জাতীয় কমিটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আবেদা সুলতানা, পুবের কলম পত্রিকার সম্পাদক আহমদ হাসান ইমরান, মুক্ত আসরের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আবু সাঈদ, উদার আকাশ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ফারুক আহমেদ।
জাতীয় অধ্যাপক, নজরুল গবেষক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘২২-২৩ বছরের একজন যুবক একটি কবিতা লিখেছে বিদ্রোহী নামে। সেই কবিতা বাংলা সাহিত্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এবং অদ্যাবধি তা বিদ্যমান। সে কবিতা কেবল নজরুলের নয়, আমি বলব, বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবিতা৷ প্রথম মহাযুদদ্ধের পর বলশেভিক বিপ্লবের পর টি.এস.ইলিয়ট The Wasteland কবিতা লিখেছিলেন যেটি ইংরেজি কবিতার বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে দিয়েছিল। তেমনি নজরুলের 'বিদ্রোহী' এই কবিতার আগে রচিত। কবিতাটিও বাংলা কবিতার প্রচলিত ধারাকে বদলে দিয়েছে। এবং রবীন্দ্রনাথের কবিতার আবহের বাইরে অনেকেই বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু সফলকাম হননি, নজরুল তা হয়েছিলেন।’
আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপচার্য তপোধীর ভট্টাচার্য বলেন, ‘বাঙালীর চিত্ত জাগরণকারী এক আশ্চর্য মানুষ তিনি। 'গাহি সাম্যের গান' কথাটি বিচ্ছুরিত হচ্ছে নানাভাবে। বারবার নজরুল পড়ছি মানে নজরুলজে পুনঃপাঠ, আগের চেয়ে আরও বেশি করে জানা। নজরুলকে তো আর টুকরো করে আনা যায় না। আমরা কী নজরুলকে পূর্ণরূপে বুঝতে পেরেছি নাকি অন্ধের মত আমিও একজন। তাই তাঁর পূর্ণরূপ বুঝতে নজরুল রচনাবলিসহ সবকিছু সঠিকভাবে পাঠ করা।’
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, ‘কাজী নজরুল ইসলাম মানুষের মানবিকতাকে, চেতনাবোধকে জাগ্রত করেছেন এবং দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ করেছেন। গণমানুষের কাছে পৌঁছেন৷ মানুষ হিসেবে মানুষের মর্যাদাকে দেখেছেন, ধর্মের দিককে আগে তুলে ধরেন নি। বাঁচার অধিকারের দিকটিকে ধর্মের সুন্দর জায়গার দিক থেকে দেখেছেন। এভাবে নজরুল আমাদের সামনে সাম্যবাদের চেতনা নিয়ে এসেছেন।
কবির নাতনি খিলখিল কাজী বলেন, ‘এখন সারা বিশ্বের বেদনায় হাহাকার। কাজী নজরুলকে এখন ভীষণ প্রয়োজন। কাজী নজরুল জীবনে কত সংগ্রাম করেছেন। জেলে গেছেন। মানবতা কথা তিনি বলেছেন। সাম্যের কথা উনার মতো কেউ এমন করে বলেনি।
ভারতের গবেষক ও লেখক অধ্যাপক সুমিতা চক্রবর্তী বলেন, নজরুল ইসলাম আন্তর্জাতিক মনন৷ তাঁর বিদ্রোহী কবিতার লক্ষ্যবস্তু দুটি-এক অত্যাচারের খড়গকৃপান, দুই উৎপীড়িতের ক্রদন রোল। এই হচ্ছে সাম্যবাদের মূলকথা৷ তিনি যখন কামাল পাশা, আমানুল্লাহ, জগলুল পাশা এদের নিয়ে কবিতা লিখেছেন তখন তিনি বিশ্বের স্বাধীনতা সংগ্রামী। বিশ্ব মানবতার স্বাধীনতার অনির্বাণ আকাঙ্ক্ষা ছিলো তাঁর মধ্যে৷ ধর্মগ্রন্থ পাঠের জগতেও নজরুল ছিলেন আন্তর্জাতিক মনন। ঈশ্বরে বিশ্বাসী হয়েও মানবতায় ছিলেন অধিক বিশ্বাসী। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষকে মেরে মানবতাকে মারা যায় না। তিনি এমনই চিন্তাধারার অধিকারী একজন আন্তর্জাতিক মনন।
পুবের কলম পত্রিকার সম্পাদক আহমেদ হাসান বলেন, ধন্যবাদ বাংলাদেশকে যে আপনারা তাঁর ইচ্ছা ‘মসজিদের পাশে আমার কবর দিও ভাই’ তা পূর্ণ করেছেন। তিনি শেষ জীবনে বাংলাদেশে যান, বাংলাদেশ তাঁকে যথাযথ সম্মান জানিয়েছে৷ এই কথাটা আমরা পশ্চিমবঙ্গবাসী কখনো ভুলবো না এবং বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ আমাদের ধন্যবাদের পাত্র।
উদার আকাশ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ফারুক আহমেদ বলেন, ধূমকেতু পত্রিকায় কাজী নজরুল ইসলামই প্রথম পূর্ণাঙ্গ সরাজের কথা বলেছেন। সেই নজরুল ইসলাম আমাদের অবিভক্ত ভারতের সমস্ত মানুষের কাছে পূর্ণ সরাজের স্বপ্ন বপন করেছিলেন৷ তিনি এমনই একজন কবি যার জন্য তৎকালীন ভারতের সমস্ত মানুষ ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মুক্তির সংগ্রামের সাহস সঞ্চয় করতে পেরেছিলেন। তিনি এভাবেই সাম্যবাদের গান গেয়েছেন।
মুক্ত আসরের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আবু সাঈদ ‘আমিই নজরুল উৎসবের প্রতিপাদ্য ‘সাম্যবাদী নজরুল’। নজরুলের যে সাম্যবাদ চিন্তা তা বর্তমানে সারা বিশ্বের জন্যই জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা মনে করি এই চেতনা তরুণদের মাঝে লালন করা এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া।
অনলাইনে দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক নজরুল উৎসবে প্রথমদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় প্রথম অধিবেশনে শত বছরে বিদ্রোহী কবিতা নিয়ে আলোচনা করেন ভারতের বিশিষ্ট লেখক ও নজরুল গবেষক মীরাতুন নাহার ও সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রিজাউল ইসলাম। সঞ্চালক হিসেবে ছিলেন সাদিয়া রশ্নি সূচনা।
দ্বিতীয় অধিবেশন রাত ৯টায় নজরুলের গান ও কবিতা পরিবেশন করেন শিল্পী গুলজার হোসেন উজ্জ্বল, নজরুলসংগীতশিল্পী মিত্রা ঘোষ (ভারত), আবৃত্তিশিল্পী লায়লা আফরোজ ও ড. পিনাকী চট্টোপাধ্যায় (ভারত)। সঞ্চালনা করেন শায়লা রহমান।
২৫ মে, দ্বিতীয় দিনের তৃতীয় অধিবেশন সকাল ১০টায় নজরুলের সাহিত্য কর্ম ও অনুবাদ নিয়ে আলোচনা করবেন ভারতের নজরুল গবেষক ও অনুবাদক ড. শেখ মকবুল ইসলাম, পর্তুগাল থেকে সংগীতশিল্পী ও বিজ্ঞানী মোস্তফা আনোয়ার স্বপন ও নজরুল গবেষক পীযূষ কুমার ভট্টাচার্য্য।
চতুর্থ অধিবেশন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় নজরুলের সাম্যবাদ ও মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে আলোচনা করবেন যুক্তরাজ্য থেকে অর্থনীতিবিদ সেলিম জাহান, ভারতের ও লেখক মবিনুল হক ও ড. মোহাম্মদ সামসুল আলম। সঞ্চালনা করবেন মুক্ত আসরের যোগাযোগবিষয় সম্পাদক আয়শা জাহান নূপুর।
রাত ৯টায় অনুষ্ঠিত হবে সমাপনী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। সমাপনী অনুষ্ঠানে কাজী নজরুল ইসলামের কনিষ্ঠ নাতনি অনিন্দিতা কাজী বলেন, ‘মুক্ত আসর এমন একটি আয়োজন করা প্রশংসার যোগ্য। নতুন প্রজন্ম, নজরুল অনুরাগীকে নতুন ভাবে অনুপ্রাণিত করবে। ১২২তম জন্মজয়ন্তীতে যেভাবে দাদুকে স্মরণ করা হচ্ছে এতে প্রামাণিত হয়,নজরুল কতটাই প্রাসঙ্গিক। তাঁর চিন্তা চেতনা, সাম্যবাদ যে চিন্তা তিনি করেছেন তা নতুনভাবে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যাক।’
সমাপনী অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন যুক্তরাজ্য থেকে কবি ও লেখক শামীম আজাদ, বাংলাদেশ ইতিহাস অলিম্পিয়াড জাতীয় কমিটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ, ড. এমরান জাহান, ড. আবেদা সুলতানা, নুরুন আখতার, আহমেদ হেলাল, উদার আকাশের প্রকাশ ও সম্পাদক ফারুক আহমেদ, মুক্ত আসরের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আবু সাঈদ সংস্কৃতিবিষয় সম্পাদক মনিরা পারভীন, ছায়ানট কলকাতার সভাপতি সোমঋতা মল্লিক, ডায়ালগ ইনের পরিচালক পিনাকী গাঙ্গুলীসহ প্রমূখ।
দুইদিনে এই আয়োজনে ৫টি দেশে থেকে ৩২ জন নজরুল গবেষক,শিক্ষাবিদ, শিল্পীরা অংশ নিচ্ছেন। ‘আমিই নজরুল আন্তর্জাতিক নজরুল উৎসবে’র সহযোগিতায় আছে বাংলাদেশ ইতিহাস অলিম্পিয়াড জাতীয় কমিটি, বইচারিতা, উদার আকাশ (ভারত), কাজী নজরুল ইসলাম ফাউন্ডেশন (নর্থ আমেরিকা) ও ডায়ালগ ইন (ভারত)।
No comments:
Post a Comment