নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: আগামী ২৭ মার্চ থেকে পশ্চিমবঙ্গে শুরু হচ্ছে বিধানসভা নির্বাচন। আর সেকথা মাথায় রেখেই রবিবার কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড থেকে প্রথম মেগা নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিল বামফ্রন্ট। আর সেই মঞ্চে আহ্বান জানানো হল জোটের শরিক কংগ্রেস ও ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ)- এর নেতাদেরও।
বামেদের তরফে এদিনের সভায় উপস্থিত ছিলেন সিপিআইএম সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সীতরাম ইয়েচুরি, বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু, সিপিআইএম পলিটব্যুরোর সদস্য মহম্মদ সেলিম, দলের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র, সিপিআই নেতা ডি.রাজা, কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি ও সাংসদ অধীর রঞ্জন চৌধুরী, কংগ্রেস শাসিত ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রী ভুপেশ বাঘেলা, আইএসএফ নেতা আব্বাস সিদ্দিকী প্রমুখ।
সীতারাম ইয়েচুরি থেকে প্রত্যেকে নেতাই রাজ্যে ফের একবার পরিবর্তনের ডাক দিলেন। ইয়েচুরি বলেন, ‘এবারের ব্রিগেড সবদিক থেকেই ঐতিহাসিক। এই ভিড় বুঝিয়ে দিচ্ছে যে এ রাজ্যের মানুষ পরিবর্তন চাইছে। মানুষের কাছে তৃণমূলের বিকল্প বিজেপি নয়। কারণ একদল দুর্নীতি ও লুঠে বিশ্বাসী, আর অন্য দল মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরিতে ব্যস্ত। তাই এবার লুঠপাটের নয়, জাতপাতেরও নয়। এবার বাংলায় পরিবর্তন চাই। জনগণের কল্যানে আসবে এমন সরকার বাংলায় চাই।’ তৃণমূলের বিরুদ্ধে একদিকে যেমন তোষণের রাজনীতির অভিযোগ তুলেছেন তেমনি বিজেপির সাথে গোপন আঁতাত নিয়েও এদিন তৃণমূলকে নিশানা করেন ইয়েচুরি।
ব্রিগেডের মঞ্চ থেকে রাজ্যের তৃণমূল সরকার ও কেন্দ্রের বিজেপি সরকার-উভয়কেই তোপ দেগে মহম্মদ সেলিম বলেন ‘রাজ্যে দিদির লুঠ, ওখানে মোদীর লুঠ। লুঠেরা কখনও লুঠেরাকে ধরে না। যারা তৃণমূলের হয়ে লুঠ করেছে, তারাই এখন বিজেপিতে নাম লিখিয়েছে। মোদি-অমিত শাহর পাঠশালা থেকেই মমতাও এখন বিভাজন শিখেছেন।’
ব্রিগেডের মঞ্চ থেকে নতুন সরকার গঠনের স্বপ্ন দেখান সিপিআইএম বিধায়ক সূর্যকান্ত মিশ্র। তৃণমূলের ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচীর কটাক্ষ করে তিনি বলেন ‘সকলেই বললো অথচ কিছুই হল না। আর পর পাড়ায় পাড়ায় সমাধান কর্মসূচী..। দিদি এমন সমাধান করেছেন যে দলটা বিজেপি হয়ে গেল। এখন উনি একাই আছেন। আপনারা যে সরকার চাইবেন, এমন একটা সরকার চাই।’
রাজ্য সরকারকে তীব্র নিশানা করে কংগ্রেস সাংসদ অধীর রঞ্জন চৌধুরী বলেন ‘এত বড় সভায় বক্তব্য রাখার সুযোগ জীবনে প্রথমবার। যারা বোঝাতে চাইছে যে এবারের নির্বাচন তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে হবে... কিন্তু এই সভাই প্রমাণ করছে যে সংযুক্ত জোট তৃণমূল-বিজেপিকেও ছাপিয়ে যাবে। আগামী দিনে তারা থাকবে না, থাকবে একমাত্র সংযুক্ত জোট। কারণ এই জোটের উদ্দেশ্যই হল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করা। আজকের সভাই প্রমাণ করছে তৃণমূল-বিজেপির অপশক্তি বিদায় নেবে। এই সরকারের বদল কেবল সময়ের অপেক্ষা।'
তবে বামেদের ডাকা এদিনের সভায় মধ্যমণি ছিলেন আইএসএফ’এর প্রতিষ্ঠাতা আব্বাস সিদ্দিকী। তিনি মঞ্চে উঠতেই গোটা ব্রিগেড জুড়ে কৌতুহলের সৃষ্টি হয়। মাঠ জুড়েই ‘আব্বাস, ভাইজান’ বলে চিৎকার শুরু করেন দর্শকরা। আব্বাসকে স্বাগত জানাতেই ব্যস্ত ছিলেন বাম নেতৃত্ব। এদিকে মঞ্চে সেসময় বক্তব্য রাখছিলেন অধীর চৌধুরী। এমন অবস্থায় কিছুটা বিব্রত হয়ে ভাষণ থামিয়ে দেন অধীর। এরপর মহম্মদ সেলিম ও বিমান বসু উভয়েই বিষয়টি বুঝতে পেরেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে এগিয়ে আসেন। ফের বক্তব্য শুরু করেন অধীর।
পরে বিজেপি ও তৃণমূলের সরকারকে তোপ দেগে আব্বাস সিদ্দিকী বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে রক্ত দিয়ে আমরা মাতৃভূমিকে রক্ষা করবো। বামেরা যেখানেই প্রার্থী দেবে, সেখানেই রক্ত দিয়ে জেতাবো। পুরোনো ইতিহাস ভুলে গিয়ে বিজেপি ও মমতার সরকারকে উৎখাত করে ছাড়বো। মমতাকে শূন্য করে ছাড়বো।’ তার অভিমত বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ’-এর জোট সমঝোতা যদি আরও এক সপ্তাহ আগে হতো তবে দ্বিগুণ মানুষের জমায়েত করতাম। কারণ বাংলার মানুষ মমতার সরকারের উপর ক্ষিপ্ত।’ তিনি আরও বলেন, ‘আপনাদের মনে হয়তো প্রশ্ন উঠতে পারে যে কেন আমি বাম শরিকদের কথাই বলে গেলাম, কংগ্রেসের নাম করলাম না। তাহলে আমি স্পষ্ট করে রাখি আমি ভাগীদারি করতে এসেছি, কারও তোষণ করতে আসেনি। অনেক হয়েছে আর নয়, পিছিয়ে পড়া মানুষদের অধিকার বুঝে নিতে এসেছি।’
তবে শারীরিক ভাবে অসুস্থ থাকার কারণে এবারের ব্রিগেডের মঞ্চে উপস্থিত থাকতে পারেন নি রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা বর্ষীয়ান বাম নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তবে শনিবার রাতেই দলের কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশ্যে এক বার্তা পাঠান তিনি। যেখানে তিনি বলেন, ‘ব্রিগেড সমাবেশ নিয়ে বিভিন্ন ভাবে খবরাখবর নেওয়ার চেষ্টা করছি। শুনে বুঝতে পারছি যে বহু মানুষ সমাবেশে আসবেন এবং অনেকে ইতিমধ্যেই এসে গেছেন। এরকম একটা বৃহৎ সমাবেশে যেতে না পারার মানসিক যন্ত্রণা বোঝানো যাবে না।’ তিনি আরও বলেন ‘মাঠে-ময়দানে কমরেডরা লড়াই করছেন আর আমি শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলেছি। ময়দানে মিটিং চলছে আর আমি গৃহবন্ধী- যা কোনদিন কল্পনাও করতে পারি নি। সমাবেশের সাফল্য কামনা করছি।’
তবে বহুদিন পর এদিনের বামেদের ডাকা ব্রিগেড সভা ছিল কানায় কানায় পরিপূর্ণ। যারা এতদিন বলতেন যে বামেরা এই রাজ্যে আণুবীক্ষণিক হয়ে গেছে, সেই বামেদের ব্রিগেডের ভিড় সত্যিই ভাবাচ্ছে তৃণমূল, বিজেপিকে।
No comments:
Post a Comment