প্রেসকার্ড ডেস্ক: ৪১ দিনের লড়াই শেষে মৃত্যুর কাছে হার মানলেন জনপ্রিয় ও বলিষ্ঠ অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। রবিবার দুপুর ১২.১৫ মিনিট নাগাদ কলকাতার একটি বেসরকারি (বেলভিউ) হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।
এদিন দুপুরে হাসপাতাল থেকে এক বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে ‘আমরা গভীর দু:খের সাথে জানাচ্ছি যে আজ (১৫ নভেম্বর) ১২.১৫ মিনিট নাগাদ বেলভিউ ক্লিনিকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আমরা তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।’
চলতি বছরের গত ৫ অক্টোবর (সোমবার) তাঁর শরীরে করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। পরদিন ৬ অক্টোবর (মঙ্গলবার) সকালে তাঁকে দক্ষিণ কলকাতার ওই বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেই থেকেই মৃত্যুর সাথে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন অসংখ্য মানুষের প্রিয় ‘ফেলুদা’। কখনও শারীরিক অবস্থা ভাল থাকলেও পরক্ষণে আচমকাই পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। এক সপ্তাহ পর ১৪ অক্টোবর তার শরীরে করোনা নেগেটিভ আসে কিন্তু কিন্তু শারীরিক জটিলতা থাকায় হাসপাতাল ছাড়া হয় নি তাঁর।
করোনার পাশাপাশি তার মূত্রথলিতে সংক্রমণ ধরা পড়ে। অক্সিজেনের মাত্রা কম হয়ে যাওয়ায় অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়া হয়। ফলে তাকে আইটিইউ’তে স্থানান্তরিত করা হয়। একইসাথে তার শরীরে সোডিয়াম ও পটাশিয়ামের মাত্রাও অস্বাভাবিক কমে যায়। তার ওপর ছিল রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস। ওষুধের মাধ্যমে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে, তাকে সুস্থ করতে তুলতে চিকিৎসকরাও ত্রুটির কোন চেষ্টা করেন নি। নন্দিত এই অভিনেতার চিকিৎসার জন্য গঠন করা হয়েছিল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দল। গত ৪১ দিন ধরে নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয় তার শরীরে।
করোনা আক্রান্ত সৌমিত্রকে কনভালসেন্ট প্লাজমা থেরাপি, মিউজিক থেরাপি সহ বেশ কিছু দেওয়া হয়। শ্বাসনালিতে অস্ত্রোপচার বা ট্রাকিওষ্টমি করা হয়েছিল। অবস্থার অবনতি হওয়ায় ভেন্টিলেশন সাপোর্টে রাখা হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু সমস্ত প্রচেষ্টাই বৃথা হয়।
গতকাল শনিবারই সৌমিত্রের চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা মেডিকেল বোর্ডের প্রধান ডা: অরিন্দম কর জানান ‘৪০ দিনের লড়াই যথেষ্ট নয়। আমরা এখন কোন একটা মিরাকেলের জন্য অপেক্ষা করছি।’ কিন্তু সেই ‘মিরাকেল’ আর আসলো না। সব আশঙ্কা সত্যি করে তিনি চলে গেলেন সকলের ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালীন অবস্থায় সৌমিত্রের নিয়মিত স্বাস্থ্যের খোঁজ নিচ্ছিলেন রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যনার্জিও। সৌমিত্র’এর কন্যা পৌলমী বসুর সাথে কথা বলে সমস্ত আশ্বাসও দেন মমতা।
করোনা ও লকডাউন আবহের মধ্যেই মনে জোর নিয়ে শ্যুটিং চালিয়ে যাচ্ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় নিজের বায়োপিক ‘অভিযান’ এর শ্যুটিং করেছিলেন। এছাড়াও সম্প্রতি এক মিউজিক রিয়িিালটি শোয়ের মঞ্চেও বিশেষ অথিথি হিসাবে হাজির ছিলেন তিনি।
জানা যায় গত ৩০ সেপ্টেম্বর কলকাতার ভারতলক্ষী স্টুডিওতে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্মের জন্য শুটিং করেন সৌমিত্র চট্টেপাধ্যায়। সেদিনই তিনি জানান তাঁর শরীর ভালো লাগছে না।
বিশিষ্ট এই অভিনেতার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে। তার মৃত্যুর খবর পেয়েই হাসপাতালে আসছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যনার্জি।
গভীর শোকজ্ঞাপন করেছেন চলচ্চিত্র পরিচালক প্রয়াত সত্যজিত রায়ের পুত্র সন্দীপ দে, অভিনেতা দীপঙ্কর দে প্রমুখ।
১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারী, পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের এক বনেদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সৌমিত্র’র যখন অল্প বয়স তখনই তাঁর পরিবার কৃষ্ণনগর থেকে হাওড়ায় এসে বসবাস শুরু করেন। ছোট বেলা থেকেই সাহিত্য অনুরাগী সৌমিত্র স্কুলের শেষ পরীক্ষার পর বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করবেন এটা অবধারিতই ছিল। কৃষ্ণনগর সেন্ট জন্স ও হাওড়া জেলা স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে কলকাতার সিটি কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্য নিয়ে সাম্মানিক শ্রেণীতে পড়ার সময়ই কলেজ ম্যাগাজিন সম্পাদনা এবং আবৃত্তিতে সৌমিত্রের বুৎপত্তি চোখে পড়ে। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য নিয়ে স্নাতোকত্তর শ্রেণীতে পড়ার সময় কিশোর বয়সের বন্ধু নির্মাল্য আচার্যের সঙ্গে সৌমিত্র শুরু করেন ‘এখন’ পত্রিকা। সম্পাদক হিসেবে সেটি ছিল সৌমিত্রের হাতেখড়ি। সেটিতে একখানি প্রচ্ছদ এঁকে দেন বিশ্ব নন্দিত পরিচালক সত্যজিৎ রায়। লম্বা ছিপছিপে সুকন্ঠের অধিকারী নাটকে পারদর্শী ছেলেটিকে সত্যজিতের মনে ধরে ছিল। ততদিনে সৌমিত্র আকাশবানী কলকাতা কেন্দ্রের ঘোষকের চাকরি পেয়ে গিয়েছেন।
সত্যজিৎ তাঁর অপুর সংসার ছবিতে প্রথম সৌমিত্রকে নিয়ে আসেন ‘অপু’র ভূমিকায়। এই ছবি দিয়েই চলচ্চিত্রে হাতে খড়ি হয় সৌমিত্রের। ১৯৫৯ সালে এই ছবিটি মুক্তি পায়। মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সৌমিত্রের অভিনয়ের স্বীকৃতি পায় সমালোচক ও দর্শকদের কাছে। সেই যে যাত্রা শুরু, এর পর থেকে সত্যজিতের ১৪ টি ছবিতে অভিনয় করেন সৌমিত্র। যার মধ্যে অন্যতম ফেলুদা, সোনার কেল্লা, জয় বাবা ফেলুনাথ, অরণ্যের দিন রাত্রি, অভিযান, শাখা প্রশাখা, ঘরে বাইরে, তিন কন্যা, চারুলতা। তিনি সত্যজিত রায় নির্মিত বিভিন্ন চরিত্রে আর্বিভূত হন। তাঁর অভিনীত কিছু কিছু চরিত্র দেখে ধারণা করা হয় যে তাঁকে মাথায় রেখেই গল্প বা চিত্রনাট্যগুলি লেখা হয়। তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলির মধ্যে সব থেকে জনপ্রিয় হল ফেলুদা। তিনি সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ‘সোনার কেল্লা’ এবং ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিতে ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেন। প্রথমে ফেলুদা চরিত্রে তার চেয়ে ভাল কাউকে নেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও তাঁর অভিনীতি ফেলুদার প্রথম ছবি সোনার কেল্লা বের হওয়ার পর সত্যজিৎ রায় স্বীকার করেন যে তাঁর চেয়ে ভাল আরও কেউ ছবিটি করতে পারত না। একসময় সত্যজিৎ রায় ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাম দুইটি প্রায় এক ব্র্যাকেটে লেখা হয়ে যেত।
সত্যজিৎ ছাড়াও মৃণাল সেন ও তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার এবং পরবর্তী সময়ে গৌতম ঘোষ, অপর্ণা সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন তিনি। ১৯৬৫ সালে মৃণাল সেনের ‘আকাশকুসুম’ ছবিতে তাঁর অভিনয় প্রচুর প্রশংসা কুড়ায়। ১৯৬১ সালে তপন সিংহের ’ঝিন্দের বন্দি’ ছবিতে সৌমিত্রের অভিনয় একটা নতুন মাত্রা যোগ করে। ১৯৬৯ সালে ‘তিন ভুবনের পারে’ ছবিতে যথার্ত কর্মাশিয়াল নায়ক হিসেবে অবতীর্ণ হন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ১৯৮৬ সালে সরোজ দে পরিচালিত ‘কোনি’ ছবিতে একজন সঁতারের কোচের ভূমিকায় দর্শক তাকে বহুদিন মনে রাখবে। এই ছবিটি যে তার অভিনীত একটি অন্যতম সেরা ছবি সেকথা নিজেও স্বীকার করেছিলেন সৌমিত্র।
রোমান্টিক নায়ক হিসেবে উত্তম কুমারের পর দর্শক সৌমিত্রকে কতটা নেবে এমন সংশয় ছিল অনেকেরই। কিন্তু সৌমিত্র তাঁর খোলা অভিনয় দিয়ে একদম পাশের বাড়ির ছেলের মতো ভীরু রোমান্টিক মননে দর্শকের মন জয় করেন। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। বাণিজ্যিক কিংবা অন্য ধারার ছবি সবেতেই তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। পাশাপাশি মঞ্চাভিনয়েও সৌমিত্র দশর্কদের মাতিয়ে দিয়েছিলেন। জীবদ্দশাতেই তিনি কার্যত কিংবদন্তীতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন তিনি।
অভিনয় জীবনে প্রায় ২৫০ এর কাছাকাছি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। ২০১৯ সালে সৌমিত্র অভিনীতি শেষ ছবি ‘সাঁঝবাতি’। লীনা গঙ্গোপাধ্যায় ও শৈবাল ব্যানার্জি পরিচালিত ওই ছবিতে অভিনয় করেছেন লিলি চক্রবর্তী, দীপক অধিকারী (দেব), পাওলি দাম প্রমুখ।
সিনেমা ছাড়ও তিনি বহু নাটক, যাত্রা এবং টেলিভিশন ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন। অভিনয় ছাড়া তিনি নাটক ও কবিতা লিখেছেন, পরিচালনা করেছেন। তিনি ছিলেন একজন উঁচু দরের আবৃত্তিকার। আসলে ‘কমপ্লিট অ্যাক্টর’ বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তা-ই।
সিনেমার মতোই থিয়েটারের মঞ্চে সমান সাবলীল ছিলেন তিনি। নাটক লেখা থেকে পরিচালনা, নাটকের সঙ্গীত থেকে মঞ্চ ভাবনা সবকিছুতেই নিজের সৃষ্টির স্বাক্ষর রাখতে ভালবাসতেন তিনি। যদিও শেষ বয়সে সিনেমায় আর বিশেষটা দেখা যেতনা এই অশীতিপর অভিনেতাকে। নিজে মুখে সেকথা স্বীকারও করেছিলেন তিনি। তিনি বলেছিলেন ‘বয়স হওয়ার ফলে এবং সিনেমায় নানা রকমের প্রজন্ম বদলাতে বদলাতে এমন জায়গায় এসেছে যেখানে সিনেমায় ভাল ভাল খুব দুর্দান্ত কাজ করার মতো সুযোগ আমি আর বেশি পাই না’।
উত্তমকুমার যখন মধ্য গগনের সূর্য ঠিক তখনই আবির্ভাব সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। বারংবার দুইজনের প্রতিভার তুলনা করে চায়ের কাপে তুফান তুলেছে বাঙালি। একজন কোনরকমে ম্যাট্রিক পাশ করে করণিকে কাজ ছেড়ে সিনেমায় এসেছিলেন। অন্যজন বাংলায় ¯œাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে আকাশবাণীর ঘোষকের চাকরি ছেড়ে সিনেমায় নেমেছিলেন। প্রাথমিক ভাবে এই অমিল নিয়েই যাত্রা শুরু হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তী কালে অভিনয়ের প্রতি প্রগাড় ভালবাসায় দুইজনেই ছিলেন নিখাদ। অভিনয় নিয়ে পড়াশোনাও করতেন দুইজনে। বিদেশী ছবি দেখে চুল চেরা বিশ্লেষণেও উত্তম ও সৌমিত্র দুইজনেই ছিলেন অদম্য। অভিনয়ের ক্ষেত্রে একজন চূড়ান্ত ভাবে রোমান্টিক, রোমান্টিকতার সঙ্গে উত্তম সমার্থক হয়ে গিয়েছিলেন। সৌমিত্র অতটা রোমান্টিক হতে পারেন নি ঠিকই, তবে তিনি ছিলেন একটু ইন্টেলেকচুয়াল, বাঙালির মনের খোরাক।
কাজের স্বীকৃতি হিসাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পেয়েছেন ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান ‘অফিসার ডেস আর্টস এট মেটায়ারস’। ইতালি সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন ‘আজীবন সম্মাননা’ পুরস্কার। ১৯৭০ সালে তিনি ভারত সরকারের দেওয়া পদ্মশ্রী সম্মান প্রত্যাখান করেন তিনি। পরবর্তীকালে ২০০৪ সালে তিনি ‘পদ্মভূষণ’ পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৭ সালে সেরা অভিনেতার স্বীকৃতি স্বরূপ ভারত সরকারের ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড-এ ভূষিত হন। ২০১২ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার লাভ করেছেন। ১৯৯৮ সালে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন। এছাড়াও বিএফজেএ’এর তরফে ৮ বার সেরা অভিনেতার সম্মাননা পান তিনি। কিন্তু পুরস্কার পেয়ে মাপা যাবে না তাঁকে। মানুষের পুরস্কার পেয়েছেন বহু আগেই।
No comments:
Post a Comment