নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: যুব মোর্চার রাজ্য সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেই ইস্তফা প্রত্যাহার করে নিলেন বিজেপি সাংসদ সৌমিত্র খাঁ। সংগঠনের পদাধিকারিদের নিয়ে তৈরি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এদিন দুপুরে সৌমিত্র লিখেছেন, ‘কোনও কমিটি চেঞ্জ (বদল) হচ্ছে না আর আমার তোমাদের ছেড়ে থাকা সম্ভব নয়, তাই ফিরে এলাম, টিএমসিকে হারানোর জন্য সব কিছু ত্যাগ করতে রাজি আছি। জয় শ্রী রাম, জয় মা দুর্গা, বিজেপি জিন্দাবাদ, মোদীজি জিন্দাবাদ।’
সৌমিত্র কেন ইস্তফা প্রত্যাহার করলেন, তা নিয়ে তাঁর কোনও বক্তব্য জানা যায়নি। তবে ওই ‘ঘর ওয়াপসি’ নিয়ে বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের চাঁছাছোলা বক্তব্য, ‘‘ও যে গিয়েছে বা ফিরেছে, তার কিছুই তো আমি জানি না! সবটাই হোয়াট্সঅ্যাপে ঘটেছে। এ বিষয়ে যা ঠিক হবে, সব পুজোর পর।’’ দিলীপ আর কিছু না বললেও রাজ্য বিজেপির এক শীর্ষনেতার বক্তব্য, ‘‘ও নাটক করছিল! যাবে কোথায়? কোনও কথা শোনে না! দলের মধ্যে সমান্তরাল সংগঠন তৈরি করছিল।’’
এখন দেখার, এই ‘প্রত্যাবর্তন’-এর পর সৌমিত্রর ঘোষিত কমিটিগুলি বহাল থাকে কি না, যা দিলীপ ভেঙে দিয়েছিলেন। রাজ্য বিজেপি সূত্রের খবর, সৌমিত্রর হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপে ইস্তফা ঘোষণার খবর জানাজানি হতে কৈলাস বিজয়বর্গীয় এবং শিবপ্রকাশ দিলীপকে ফোন করেছিলেন। দিলীপ তাঁদের স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, সৌমিত্র দলের মধ্যে সমান্তরাল সংগঠন তৈরি করার চেষ্টা করছিলেন, যা তিনি মানবেন না। তাই কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সম্ভবত তার পরেই সৌমিত্র বুঝে যান, ইস্তফা দিয়ে লাভ নেই। এখন প্রত্যাবর্তনই শ্রেয়। পরে আলোচনা সাপেক্ষে যা হওয়ার হবে। কিন্তু তিনি পদে না থাকলে তাঁর ঘনিষ্ঠদেরও কোনও জায়গা থাকবে না।
প্রসঙ্গত, সংগঠনের পদাধিকারিদের নিয়ে তৈরি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ছেড়ে শনিবার সকালে সৌমিত্র বেরিয়ে গিয়েছিলেন। যুব মোর্চার রাজ্য পদাধিকারিদের নিয়ে যে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ রয়েছে সেটির নাম ‘বিজেওআইএম ওয়েস্টবেঙ্গল অফিশিয়াল’। শনিবার সকাল ৯টা ৪ মিনিট নাগাদ ওই গ্রুপে সৌমিত্র লেখেন, ‘শুভ মহাষ্টমী। সকলে ভাল থাকবেন। আপনাদের খুবই সহযোগিতা পেয়েছি। আমি চাই বিজেপি-কে সরকারে আনতেই হবে। তাই হয়ত আমার অনেক ভুল ছিল যাতে দলের ক্ষতি হচ্ছিল। তাই আমি ইস্তফা দেব আর সকলে ভাল থাকবেন। যুব মোর্চা জিন্দাবাদ, বিজেপি জিন্দাবাদ, মোদীজি জিন্দাবাদ’। তবে বিতর্ক তাতে থামেনি। যুব মোর্চার অন্য শীর্ষনেতারাও তোপ দাগতে শুরু করেন সৌমিত্রের বিরুদ্ধে।
যুব মোর্চার জেলা কমিটিগুলি শুক্রবার দুপুরেই ভেঙে দিয়েছিলেন দিলীপ। জেলা সভাপতিদেরও বরখাস্ত করেছিলেন। ওই সব জেলা সভাপতি এবং জেলা কমিটি মনোনীত করেছিলেন সৌমিত্রই। যুব মোর্চার রাজ্য সভাপতি হিসেবে জেলা সভাপতিদের বেছে নেওয়ার অধিকার সৌমিত্রের রয়েছে। কিন্তু যুব সংগঠনের জেলা সভাপতিদের বেছে নেওয়ার আগে বিজেপির সংশ্লিষ্ট জেলা সভাপতিদের সঙ্গে সৌমিত্র কোনও আলোচনা করছিলেন না বলে দলের একাংশের দাবী। বিভিন্ন জেলা থেকে দিলীপের কাছে অভিযোগ পৌঁছাচ্ছিল। তার প্রেক্ষিতেই দিলীপ কঠোর পদক্ষেপ করেন। তার পরেই সৌমিত্রের ইস্তফার ঘোষণা।
তদবধি দলের একটি অংশ সৌমিত্রের প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছিলেন। তবে তারা নেহাতই সংখ্যালঘু। বিজেপিতে দিলীপের বিরোধী শিবিরের নেতারাও সৌমিত্রের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন। দলের রাজ্য কমিটির সদস্য তথা যুব মোর্চার রাজ্য সহ-সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডা বলেছিলেন, ‘‘সৌমিত্র খাঁ অত্যন্ত অপরিণত রাজনীতি করছেন। সামনেই নির্বাচন। তার আগে গোটা দলকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলাই নেতাদের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ।’’ শঙ্কুর মতে, জেলা কমিটিগুলি গঠনের ক্ষেত্রে সৌমিত্রের আরও ‘যত্নবান’ হওয়া উচিৎ ছিল। পুরনো কর্মীদের আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি ছিল। যুব মোর্চার আরও অনেক শীর্ষনেতা মুখ খুলতে শুরু করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে রাজ্য সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ দাস অন্যতম। দিলীপের ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসেবে পরিচিত প্রকাশ সংবাদমাধ্যমে কোনও মন্তব্য না করলেও সংগঠনের অন্দরে তিনি সৌমিত্রের বিরুদ্ধে ‘তীব্র বিষোদগার’ শুরু করেছেন বলে যুব মোর্চা সূত্রের খবর।
কৈলাস বিজয়বর্গীয় এবং মুকুল রায়ের ঘনিষ্ঠ হিসেবেই বিজেপিতে পরিচিতি সৌমিত্রের। এই ডামাডোলে সেই কৈলাস-মুকুল গোষ্ঠীও খোলাখুলি ভাবে সৌমিত্রের পাশে দাঁড়াতে পারেনি। ওই গোষ্ঠীর আরেক ‘ঘনিষ্ঠ’ শঙ্কুদেবের মন্তব্যেই সে কথা স্পষ্ট। তবে দিলীপের পদক্ষেপকেও পুরোপুরি সমর্থন করছেন না শঙ্কুরা। তাঁর কথায়, ‘‘দিলীপ দা অন্য ভাবেও সমস্যার সমাধান করতে পারতেন। দলের ভিতরে কথা বলে সমস্যা মেটানো যেত। আচমকা যুব মোর্চার সব জেলা কমিটিকে বরখাস্ত করে দিয়ে সংগঠনের রাজ্য সভাপতিকে দিলীপ দা যে অস্বস্তির মুখে ফেললেন, সেটা না হলেই ভাল হত।’’
জেলা কমিটির পাশাপাশিই সমস্যা তৈরি হয়েছে যুব মোর্চার রাজ্য কমিটি নিয়ে। যেমন পদাধিকারী মণ্ডলীতে সম্প্রতি পামেলা গোস্বামীর অন্তর্ভূক্তি কেন্দ্র করে ঝামেলা তৈরি হয়েছে। রাজ্যনেতাদের অনেকেই চাইছিলেন, পিটিটিআই আন্দোলনের প্রথমসারির মুখ পিন্টু পাড়ুইকে সহ-সভাপতি করা হোক। কিন্তু সৌমিত্র সেই ইচ্ছাকেও মর্যাদা দেননি।
এখন অবশ্য সৌমিত্র ‘প্রত্যাবর্তন’ ঘটানোয় দিলীপের কড়া অবস্থানই মান্যতা পেল বলে দলের একাধিক নেতার অভিমত।
পুজোর পর আলেোচনায় এই কাজিয়ার জল কোথায় গড়ায়, সেটাই দেখার।
No comments:
Post a Comment