নিজস্ব সংবাদদাতা, উত্তর দিনাজপুর: বাঙালিদের বারো মাসে তেরো পার্বন। আর তেরো পার্বনের মধ্যে একটি অন্যতম পার্বন কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা। আর পাঁচজন বাঙালিরা যখন ঘরে ঘরে লক্ষ্মী পুজোয় ব্যস্ত, ঠিক তার উল্টো চিত্র উত্তর দিনাজপুর জেলার কালিয়াগঞ্জের ৭ নম্বর ভাণ্ডার গ্রাম পঞ্চায়েতের পূর্ব ভাণ্ডার গ্রামে।
লক্ষ্মী পুজোর আগে দশমীর পরের দিন থেকে গ্রামের কোন বাড়ীতে আমিশ রান্না হয় না। গ্রামের সকলে মন্দির প্রাঙ্গনে লক্ষ্মী পূজা করতে ব্যস্ত থাকে। গ্রামবাসীরা জানান, 'আজ থেকে প্রায় ২৬ বছর আগে লক্ষ্মী পূজাকে কেন্দ্র করে গ্রামে বাউল উৎসব চলছিল। সেই সময় গ্রামের কৃষক নরেশ চন্দ্র বর্মন , স্থানীয় গোকুল চন্দ্র বর্মণের জমিতে চাষ করার সময় নরেশ বাবুর লাঙ্গলের ফলায় আটকে যায় একটি পাথর। সঙ্গে সঙ্গে তিনি কোদাল দিয়ে পাথরটিকে তোলেন। পাথরটি জল দিয়ে পরিষ্কার করলে দেখা যায় কালো পাথরে খোদাই করা লক্ষ্মী নারায়নের মূর্তি। মূর্তি পাওয়ার খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়তেই সেই গ্রাম থেকে এমনকি দূরদূরান্ত থেকে কয়েক হাজার লোক হাজির হয়ে যায় ঐ মাঠে। এরপর পূর্ব ভাণ্ডার গ্রামের বাসিন্দারা ঐ কালো পাথরের মূর্তিটিকে তাঁদের গ্রামে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে নিয়ে আসে। খবর পেয়ে কালিয়াগঞ্জ থানা, জেলা প্রশাসন ও প্রত্নতাত্ত্বিকরা ছুটে আসে। মূর্তিটির পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জানা যায় সেটি কষ্টি পাথরের মূর্তি। মূর্তিটি লম্বায় প্রায় দেড় ফিট, চওড়ায় এক ফিট। প্রশাসনের তরফ থেকে মূর্তিটিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হলে গ্রামবাসীদের বাঁধার মুখে পরে প্রশাসনকে খালি হাতে ফিরে যেতে হয়। এরপর পূর্ব ভাণ্ডার গ্রামের বাসিন্দারা একটি মন্দির বানিয়ে মূর্তিটির পুজো শুরু করে তখন থেকে।'
সারা বছর নিয়ম নিষ্ঠার সঙ্গে দুবেলা করে পুজো করলেও কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর দিনটিতে মহাসমারহে পুজোর আয়োজন করা হয় এখানে। প্রতিবছর লক্ষ্মী পুজোর দিন গ্রামের মহিলারা বাড়ীর লক্ষ্মী পুজো কোনমতো সেরে সন্ধ্যার মধ্যে লক্ষ্মী নারায়ন পুজো মণ্ডপে এসে হাজির হন, কারন মন্দিরে পূজা না করলে তাদের পূজা সম্পন্ন হয় না। পুজোকে কেন্দ্র করে গ্রামের সমস্ত মহিলারা উপোস থাকেন। কিন্তু এবছর চিত্র টি একটু আলাদা করোনা আবহের কারণে।
বছরের প্রতিদিন নিয়ম করে সকাল ও সন্ধ্যের সময় পুজো করা হয় এখানে। এই লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির খুব জাগ্রত। এখানে কেউ কোন কিছু মানত করলে মা লক্ষ্মী তাঁদের খালি হাতে ফেরান না। তাই গ্রামে বিয়ে বা অন্নপ্রাশন হলে লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দিরে এসে গ্রামবাসীরা প্রথমে পুজো দিয়ে যান। এই মন্দিরে গোটা বছর ধরে প্রচুর সোনা ও রুপার গহনা দান করেন ভক্তপ্রাণ মানুষজন। এই সকল গহনা সযত্নে জমা রাখা হয় লক্ষ্মী মাতার নামে। যার জমিতে এই কষ্টি পাথরের দেবী মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল, সেই গোকূল চন্দ্র বর্মণ লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির করার জন্য ২ কাঠা জমি দান করেছেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এখানে লক্ষ্মী নারায়ণ পুজো নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা হচ্ছে। পূর্ব ভাণ্ডার গ্রামের লক্ষ্মী নারায়ণের পুজোকে কেন্দ্র করে আসে পাশের গ্রাম থেকে কয়েক হাজার লোকের সমাগম হয় এখানে। এখানে বিশাল মেলা বসার পাশাপাশি তিন দিন তিন রাত ধরে চলে বাউল গানের আসর। জেলা সহ জেলার বাইরে থেকে প্রতিবারের ন্যায় এবারও বেশ কয়েকটি দল বাউল গানে অংশ নেয়। বাউল গান চলাকালীন সময়ে এখানে প্রতিদিন প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার লোকের সমাগম ঘটে। তিন দিন পর মহাপ্রভুর ভোগ দিয়ে মেলা ভাঙ্গা হয়। কিন্তু এবছর পূজা ছাড়া কিছুই হচ্ছে না। তাই গ্রাম বাসীদের মনে বিশাদের ছোঁয়া। এবছর সরকারি বিধি মেনেই পুজো সম্পন্ন করা হবে বলে জানান পুজো কমিটির কোষাধক্ষ্য নিরঞ্জন রায়।
No comments:
Post a Comment