সংবাদপত্রের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ঘরে ঢুকে পড়তে পারে, এরকম একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছে দেশের নানা প্রান্তে। ফলে সংবাদপত্রের বিক্রি হুহু করে কমছে। সে কারণে মুম্বাইয়ের বেশ কিছু সংবাদপত্র যেমন তাদের প্রিন্ট সংস্করণ বন্ধ করে দিয়েছে। বৃহস্পতিবার কলকাতার বেশ কিছু কাগজও বের হয়নি।
কলকাতার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পঠিত কাগজ বলে পরিচিত বর্তমানের কোনও প্রিন্ট সংস্করণ বের হয়নি নি। বন্ধ হয়েছে আজকাল এবং সিপিআইএম দলের দৈনিক মুখপাত্র গণশক্তিও।
সংবাদপত্রগুলোর প্রকাশকেরা কদিন ধরেই পাঠকের মনের এই আশঙ্কার কথা টের পাচ্ছিলেন। তাই শুরু হয়েছিল বিজ্ঞাপন এবং খবরের মাধ্যমে মানুষের মনের এই ভয় কাটানোর নানা চেষ্টা।
কলকাতায় সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর ম্যানেজিং ডিরেক্টর ডি ডি পুরকায়স্থ বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা তো বিজ্ঞাপন দিয়ে আর খবরের মাধ্যমে মানুষের মনে এই ভয়টা কাটানোর চেষ্টা করছি যে এটার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিই নেই।’
কিন্তু তাতে তেমন কাজ হচ্ছে না বলেই মনে হয়। যে কারণে ডি ডি পুরকায়স্থ বলেন, ‘এরকম কঠিন সময়ে তো, আসলে ভাইরাস যত না দ্রুত ছড়ায়, তার থেকে দ্রুত ছড়ায় গুজব।’
পুরকায়স্থ আরও দাবি করেন, তাদের গোষ্ঠীর দুটি পত্রিকা - আনন্দবাজার এবং দ্যা টেলিগ্রাফ - দুটিই সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় ছাপা হয় এবং নিরাপদেই পৌঁছে কাগজের পরিবেশকদের কাছে।
তবুও বহু মানুষ নিজে থেকেই পত্রিকা নিতে চাইছেন না। তারা নিজেরাই হকারদের নিষেধ করে দিচ্ছেন।
এ সম্পর্কে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা শৈবাল দাশগুপ্ত বিবিসিকে বলেন, ‘সংবাদপত্র ছাপা হয়তো হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে, কিন্তু ডিস্ট্রিবিউটরের পরে সেটা যখন বিলি হচ্ছে আমাদের বাড়ীতে, সেই প্রক্রিয়াটা কতটা নিরাপদ, কতটা জীবানুমুক্তভাবে সেটা করা হচ্ছে - সেটা তো আমরা জানি না।’
তার আরও যুক্তি, ‘ছাপাখানা থেকে বেরনোর পর তো একটা কাগজ নানা জায়গা হয়ে তারপরে আমার বাড়ীতে আসছে। এর মধ্যে কোনও জায়গা যে সংক্রমিত নয়, বা যে হকার কাগজ দিচ্ছেন, তিনি যে কোনও সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসেন নি - তার কোনও গ্যারান্টি তো নেই।’
তাই তিনি কাগজ নেওয়া বন্ধ রেখেছেন।
শুধু কাগজ দোষী নয়
সংবাদপত্র থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা সম্পর্কে কলকাতায় অবস্থিত অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ হাইজিন এন্ড পাবলিক হেল্থ-এর পরিচালক মধুমিতা দোবে মনে করেন, সংক্রমণ ছড়ানোর একটা সম্ভাব্য মাধ্যম সংবাদপত্র ঠিকই। কিন্তু আলাদা করে শুধু কাগজের ওপরে জোর দেওয়াটা ঠিক নয়।
তিনি বলেন, ‘সংক্রমিত রোগীর ড্রপলেট শুধু কাগজ কেন দরজার হাতল, চেয়ার, টেবিল, কম্পিউটার সহ অনেক জায়গাতেই পড়তে পারে। এখানে শুধু কাগজের ওপরে জোর না দিয়ে ওই সবকটি জিনিস হাতের সংস্পর্শে আসার পরেই হাত ভাল করে সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলা দরকার।’
অর্থাৎ, সংবাদপত্র থেকে সংক্রমণের সম্ভাবনা যে একেবারেই নেই, তা নয়।
তবে শৈবাল দাশগুপ্ত মনে করেন কারেন্সি নোট বা প্যাকেট বন্দি খাবারের থেকেও সংক্রমণ ছড়াতে পারে। ‘জানি ওসব থেকেও সংক্রমণ ছড়াতে পারে, তবুও যতটা সম্ভব সংক্রমণ বাড়ীতে ঢোকার পথ তো বন্ধ করতেই হবে।’
‘আর কাগজও যেহেতু একটা সম্ভাবনা, তাই সেটাকে আপাতত বন্ধ রেখেছি। আর খবর জানার জন্য ওই সব কাগজের ইন্টারনেট সংস্করণ তো আছেই’, বলছিলেন শৈবাল দাশগুপ্ত।
আর এই একই ভয় থেকে বহু মানুষ নিজেরাই কাগজ দিতে বারণ করে দিয়েছেন হকারদের। ফলে, হু হু করে কমছে কাগজের সার্কুলেশন।
হকারদের উদ্বেগ
উত্তর ২৪ পরগণা জেলার সোদপুর শহরের এক বড় সংবাদপত্র বিক্রেতা দীননাথ সিংহ রায়। তিনি বলছিলেন, কাগজ বন্ধ হওয়ার অনেকগুলো কারণ আছে, শুধুই যে পাঠকের ভয়, তা নয়।
তিনি বলেন, ‘ট্রেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলেও আমরা যে কাগজ আনতে পারছি না কলকাতা থেকে, সেটাও একটা কারণ। আবার যে হকাররা বাড়ী বাড়ী কাগজ দেন, তিনিও এই লকডাউনের মধ্যে বাড়ীর বাইরে বেরুতে সাহস পাচ্ছেন না। রাস্তায় লোক নেই, তাই পথ-চলতি মানুষ যে সংখ্যক কাগজ কিনতেন, সেটা অর্ধেকেরও কম হয়ে গেছে। আমরা তাই কাগজ নিয়ে এসে জমিয়ে রেখে কী করব?’
কয়েকটি সংবাদপত্র গোষ্ঠী এজেন্ট এবং হকারদের মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণ থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে গ্লাভস দিয়েছিল। তবে দীননাথ বলেন, ওই গ্লাভস তো একবার ব্যবহার করেই ফেলে দিতে হয়।
তবে কলকাতার বর্তমান পত্রিকার প্রকাশক জীবানন্দ বসু বিবিসি বাংলাকে জানান, শুক্রবার থেকে তারা আবারও ছাপা শুরু করার পরিকল্পনা করেছেন। অবস্থার উন্নতি হওয়ার খবর পাওয়ার পরই তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানান তিনি।
এ অবস্থায় আজকাল পত্রিকাও শুক্রবার প্রিন্ট সংস্করণ বের করার কথা জানিয়েছে।
তবে মুম্বাইয়ের সংবাদপত্রগুলি পয়লা এপ্রিলের আগে কাগজ ছাপবে না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

No comments:
Post a Comment