জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জি ও তার স্ত্রী এস্থার ডুফলো। বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক প্রবন্ধে এই আহ্বান জানান তারা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ‘সর্বাধিক প্রশাসন, ন্যূনতম সরকার’ (ম্যাক্সিমাম গভর্ন্যান্স, মিনিমাম গভর্নমেন্ট)-এর শ্লোগান দিয়েছিলেন। সেই শ্লোগান বহু ভোটারের মনে অনুরণন তুলেছিল। জনগণ ভেবেছিল সরকার তাদের জীবনযাপনে বড় ছায়া হয়ে উঠছে, সে তুলনায় সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্তির পরিমাণ খুবই কম। সর্বাধিক প্রশাসন ও ন্যূনতম সরকার মধ্যেকার দ্বন্দ্বের সমাধান করার জন্য একটা বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া দরকার। সেটা হল, রাষ্ট্র খুব বেশি ভারি না হয়ে উঠেও কীভাবে কার্যকর হতে পারে।
সিএএ ও এনআরসির সমালোচনা করে অভিজিৎ দম্পতি জানিয়েছেন, ‘নাগরিকত্ব যদি স্থির না করা যায়, তাহলে তারা অপরাধী গণ্য হবেন বলেই ধরে নেওয়া যায়। বিদেশি হলে অপরাধী ও রাষ্ট্রহীন হিসেবে চিহ্নিত হবে। এটা ওই শ্লোগানের বিষয় নয়। এটা হল মানুষের নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার প্রশ্নে অবাঞ্ছিত সরকারি হস্তক্ষেপ।’ নোবেলজয়ী অভিজিৎ দম্পতি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘যদি তুমি দেশের নাগরিক না হও, তাহলে এতোদিন তুমি কোথায় বসবাস করলে? কেউ যদি তোমাকে না চায়, তাহলে তুমি কে? এ প্রশ্নটাই বহু তরুণ-তরুণীকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সরকারের আরও একটা উদ্বেগের বিষয় আছে। নাগরিকত্ব নিয়ে সব আলোচনাতেই ধরে নেওয়া হচ্ছে অভিবাসীরা যেন একটা সমস্যা। আসামে, এই ধারণার একটা সমাধানও হয়েছে- অভিবাসী মাত্রেই সমস্যা, তা সে যে ধর্মেরই হোক না কেন। সে কারণেই এখানে সিএএ অভিশপ্ত বলে গণ্য এবং যথেষ্ট সংখ্যক বিদেশি আটক করতে না পারায় এনআরসি-র কোনও জনপ্রিয়তা নেই।’ অভিজিৎ বলেন, আমাদের নতুন বই ‘গুড ইকনমিক্স ফর হার্ড টাইমস’-এ আমরা দেখিয়েছি যে কম দক্ষতার আর্থিক অভিবাসীদের জন্য আর্থিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে না। সব তথ্য-প্রমাণ থেকে দেখা যাচ্ছে, কম দক্ষতাসম্পন্নদের ব্যাপক পরিমাণ অভিবাসনের পরও অন্য কম দক্ষতার অভিবাসীদের আয়ের তারতম্য ঘটেনি। তার একটা কারণ হল আর্থিক অভিবাসীরা সুযোগের জন্য মুখিয়ে থাকেন এবং সামনে যা আসে তাই গ্রহণ করেন। স্থানীয় অধিবাসীরা যে সব কাজ করতে চান না, এই অভিবাসীরা সেসব কাজও করেন। আরেকটা কারণ হল, এই অভিবাসীরা যে শুধু শ্রম বিক্রি করেন, তাই নয়, তারা নতুন উপার্জন দিয়ে খাবার কেনেন, চুল কাটেন বা আরও নানা উপায়ে অর্থ খরচ করে থাকেন।
অভিজিৎ বলেন, ‘মধ্যবিত্তদের আসল আর্থিক চ্যালেঞ্জ হল, তাদের আশঙ্কা এতোদিন ধরে তারা যে প্রাপ্তির জন্য হাঁ করে তাকিয়ে থাকতো, এই নতুন গোষ্ঠী এবার তাতে ভাগ বসাবে। তাদের কাছে শেষ প্রাপ্তি হল সরকারি চাকরি। তবে বেহাল প্রশাসনের নমুনা হল সরকারি চাকরির অপ্রতুলতা- যার একটি উদাহরণ ২০১৯ সালে রেলওয়ের তৃতীয় শ্রেণির ৬৩ হাজার চাকরির জন্য আবেদন করেছিলেন এক কোটি নব্বই লাখ ভারতীয়। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে আমরা যা পাচ্ছি তার মধ্যে কোথাও গলদ রয়েছে।’
তারা জানিয়েছেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে স্থানীয় জনতার জন্য আর্থিক ন্যায়ের প্রশ্ন। এখনও যদি এ প্রশ্নের মুখোমুখি না হওয়া যায়, তাহলে সারাদেশেই এ প্রশ্ন আরও বিচ্ছিন্নতা সহকারে উঠতে থাকবে, উঠতে শুরুও করেছে। চেন্নাইয়ে বাঙালি হিন্দু অভিবাসীর তামিলভাষী সন্তান কি সে রাজ্যের সরকারি চাকরি পাবে? বিহার থেকে আসা মারাঠিভাষী সন্তানেরা, যারা মহারাষ্ট্রে বেড়ে উঠেছে তারা? এসব নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হতেই ভাবুন, বেসরকারি ক্ষেত্রের ভাল ভাল চাকরির কথা! আর শুধু রাজ্যের সীমার মধ্যেই বা আটকে পড়ে থাকবেন কেন? মুম্বই শহরের চাকরি কি মুম্বইকরদের জন্য? অভিবাসন নিয়ে এই যে প্যারানোইয়া, তা হলো এমন এক জিন, যাকে পত্রপাঠ বোতলে ভরে ফেলা উচিৎ।
নোবেলজয়ী অভিজিৎ দম্পতি বলেছেন, সমাধানের সেরা উপায় হল ভারতের সেই দর্শনকে আলিঙ্গন করা, যেখানে ভারত বহু সভ্যতার জননী। যারা গণতান্ত্রিক, খোলামেলা, সহিষ্ণু, সবাইকে গ্রহণ করতে সক্ষম হিসেবে যারা জাতীয় উদ্যোগে যোগ দিয়েছেন, তেমন সবার জন্য আমরা দরজা খুলে দেবো না কেন? কেন দরজা খুলে দেবো না পাকিস্তানের নিপীড়িত আহমেদি ও শ্রীলঙ্কার হিন্দুদের জন্য? আমরা ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ, আর কয়েক লাখ নিমেষে মিশে যাবে। তাহলে আমরা সত্যিই সারাবিশ্বের ধ্রুবতারা হয়ে উঠবো।
উল্লেখ্য, গত ১২ ডিসেম্বর ৫৫ বছরের পুরনো নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন করে দেশ। সংশোধিত আইনে প্রতিবেশী তিন দেশ থেকে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন, পার্সি ধর্মাবলম্বীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আইনটিকে মুসলিমবিরোধী আখ্যা দিয়ে দেশ জুড়ে চলছে বিক্ষোভ। এতে অন্তত ২৬ জন নিহত হয়েছে।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
No comments:
Post a Comment