সেলফি এক যুগান্তকারী অধ্যায়। সেলফি যে তুলতেই হবে! দিনের শুরু থেকে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত সেলফি না তুলে কি থাকা যায়! ভাবতেই অবাক লাগে। কিন্তু সেলফির নেশা দিন দিন জীবনের গুরুত্ব কমিয়ে দিচ্ছে। তরুন-তরুনীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেলফি তুলতে ব্যস্ত। এভাবে যে মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে, তাতে কোন খেয়াল নেই। সেলফি তুলতে গিয়ে কতজন জীবন হারাচ্ছে। তবু এ মরন নেশা পেয়ে বসেছে সবার অন্তরে।
অন্তত পরিসংখ্যান তা-ই বলছে। ২০১১ অক্টোবর থেকে ২০১৭-র নভেম্বর পর্যন্ত শুধুমাত্র সেলফি নিতে গিয়ে গোটা দুনিয়াতে মৃত্যু হয়ছে ২৫৯ জনের। ‘জার্নাল অব ফ্যামিলি মেডিসিন অ্যান্ড প্রাইমারি কেয়ার’-এর সমীক্ষা ও তার ফল অনুযায়ী, ওই নির্দিষ্ট সময়ে পৃথিবীতে হাঙরের কামড়ে মৃত্যু হয়েছে মোটে ৫০ জনের। অর্থাৎ মৃত্যুর অঙ্কে হাঙরের কামড়কে পাঁচ গুণেরও বেশি পিছনে ফেলে দিচ্ছে ‘সেলফাইটিস’ (ঘন ঘন সেলফি তোলার প্রবণতা)। গত ১০ বছরে এই ‘অসুখ’ আরও বেড়েছে বলেই মত মনোবিদদের।
মূলতঃ মহিলাদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি দেখা গেলেও সমীক্ষায় প্রকাশ, পুরুষদের মধ্যেও এই আসক্তি ক্রমেই বাড়ছে। অনেক সময় মহিলাদের সেলফি তোলায় সাহায্য করতে গিয়েও মৃত্যু হচ্ছে তাঁদের। এর মধ্যে জলে ডুবে মৃত্যু, পথ দুর্ঘটনা, শ্যুটিং'য়ের সময় ঘটা দুর্ঘটনার সংখ্যাই বেশি। আজ পর্যন্ত দেশে সেলফির ফাঁদে পড়ে প্রাণ দিয়েছেন প্রায় ১৫৯ জন। দেশের প্রায় ১৩০ কোটির বেশি জনগণের মধ্যে প্রায় ৮০ কোটি মানুষই মোবাইল ব্যবহার করেন ও সেলফিতে কমবেশি অভ্যস্ত। দেশে রেলের ধাক্কায় মৃত্যুর ক্ষেত্রেও অনেক সময় দায়ী থাকে এই সেলফিপ্রেম।
‘সেলফি’ শব্দটি কয়েক বছর আগে ‘অক্সফোর্ড অভিধান’-এর প্রবেশ করেছে। ‘কেমন করে আরও ভাল সেলফি তুলবেন’— এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সার্চ ইঞ্জিনগুলোতে গেলেই ঝাঁকে ঝাঁকে ওয়েবসাইট খুলে যায়। শুধু ‘সেলফি স্টিক’ নয়, নিজস্বী তোলার জন্য বিশেষ জুতোও এসে গিয়েছে বাজারে। সেলফি-ফ্রেন্ডলি হওয়ার উপরেই স্মার্টফোনের বিক্রি বাড়ছে। ইতিমধ্যে ইউরোপে ‘সেলফি স্টিক’ কে ‘নার্সিসাস স্টিক’ বলেও ডাকা হচ্ছে।
শুধু ভারত নয়, সব উন্নয়নশীল দেশ ও পিছিয়ে পড়া দেশরাও সেলফিমুগ্ধতায় ভরপুর। কেবল আমজনতা নন, এই প্রেমে মশগুল সেলিব্রিটিরাও। তাইওয়ানে গত জানুয়ারিতেই ‘বিকিনি ক্লাইম্বার’ সোশ্যাল মিডিয়ার সেলিব্রিটি গিগি উও পর্বতের শিখরে উঠে সেলফি নিতে গিয়ে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে প্রাণ হারান। ক্রোয়েশিয়ার উদ্ধারকারী দল সেলফির বিরুদ্ধে ট্যুইট করতেও বাধ্য হয়। আমেরিকা, রাশিয়ার মতো দেশেও সেলফি তুলতে গিয়ে প্রতি বছরই কারও না কারও মৃত্যু ঘটে। দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ভারতেও বিভিন্ন জায়গায় সেলফি তোলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেলফি তোলার জেরে ঘটে চলা দুর্ঘটনায় রাশ টানতে ও সচেতনতা প্রসারে রাশিয়ার রাস্তাঘাটে সেলফি তোলা নিয়ে সতর্কতা জারি করেছে দেশের সরকার।
‘সেলফাইটিস’ নিয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অমিতাভ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এই সেলফি তোলায় কেবল মৃত্যুর সংখ্যা দেখলেই এর ভয়াবহতা বোঝা যায় না। যাঁরা মারা যাচ্ছেন না অল্পের জন্য বা বিপজ্জনক ভাবে সেলফি তুলছেন, তাঁরাও যে কোনও দিন দুর্ঘটনার শিকার হতে পারেন। এটা একটি মানসিক অসুখ। অবসাদ ও তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গিয়ে অনেক সময় ব্যক্তিটি নিজের মানসিক তৃপ্তির জন্য এমন করেন। ছবি এডিট করে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে প্রচুর ভাল কমেন্ট এবং লাইক পেতে চাওয়ার এই খিদে আসলে মানুষ কতটা অসুখী, নিরাপত্তাহীন ও মন কেমনের শিকার, সে দিকেই ইঙ্গিত দেয়।’’
সূত্র: বিডিএইচ
No comments:
Post a Comment