বাতিল হতে পারে আসামের এনআরসি। নাগরিকত্ব বিল সংশোধন করে ফের লোকসভা ও রাজ্যসভায় আনা হবে। আফগানিস্তান বাদে চারপাশের মুসলিম দেশ থেকে আসা অমুসলিমদের নাগরিকত্ব দিয়ে তারপর করা হবে এনআরসি। দৈনিক যুগশঙ্খ ১৩ অক্টোবর কলকাতা সংস্করণে এই প্রতিবেদন করেছে। দৈনিক যুগশঙ্খ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হল। দেশ জুড়ে আসছে এনআরসি। তবে তার আগে হবে নাগরিকত্ব বিল অর্থাৎ ক্যাব। বাংলায় নাগরিকত্ব বিলের বিরোধীতা করলেও সংসদে ভোটাভুটিতে থাকবে না তৃণমূল।
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর নেবেন রঞ্জন গগৈ। এর আগে, রাম মন্দির বাবরি মসজিদ মামলার ফয়সালা হয়ে যাবে। এবং এরপর নাগরিকত্ব বিল ও সারা দেশ জুড়ে এনআরসি করানোর জন্য পুরো শক্তি দিয়ে মাঠে নামবে বিজেপি। নতুন করে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (ক্যাব) ফির আনা হবে। নতুন বিলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে ‘ধর্মীয় নির্যাতন’ বা ‘ধর্মীয় নির্যাতনের আশঙ্কায় যেসব অমুসলিম ওই দেশগুলাে থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের নাগরিকত্ব পথ সুগম করা স্পষ্ট উল্লেখ থাকবে।শুধু তাই নয়, এবার সরাসরি দেশভাগের শিকার’ শব্দবন্ধটিও নাগরিকত্ববলে থাকবে। নতুন বিলে বিলে আফগানিস্তানকে বাদ দেওয়া হবে। বিশ্বস্ত সূত্রে এ খবর জানা গেছে। শুধু তাই নয়, অসমে ৩১ আগস্ট নাগরিকপঞ্জি কি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ পেয়েছে সেটি খারিজ করবে সরকার। সূত্রটির ইঙ্গিত, সারা দেশে নতুন করে এনআরসি করানো হবে। তবে এর আগে মুসলিম উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার। ১৯৫১ সাল হওয়ার সম্ভাবনা আদৌ উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
প্রসঙ্গত, প্রথম দফায় ২০১৬ সালে নরেন্দ্র মোদি সরকার যে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল এনেছিল তাতে সরাসরি ধর্মীয় নির্যাতন বা ‘ধর্মীয় নির্যাতনের আশঙ্কা’ শব্দবন্ধ ছিল না। বরং এ ক্ষেত্রে ২০১৫ সালে সরকার যে দুটো নোটিফিকেশন এনেছিল, সেগুলোকে ভিত্তি করেই বিল তৈরি করা হয়েছিল। ওই জোড়া নোটিফিকেশন, যা কার্যত ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রুল’, এর মূল কথা হচ্ছে, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে ‘ধর্মীয় নির্যাতন বা ধর্মীয় নির্যাতনের আশঙ্কায় পালিয়ে আসা অমুসলিম শরণার্থীদের ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’হিসাবে চিহ্নিত করা হবে না। ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই সেসময়কার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বিলের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যে বিবৃতি দিয়েছিলেন তাতে ‘দেশভাগের শিকার হয়ে ধর্মীয় নির্যাতন’ বা ‘ধর্মীয় নির্যাতনের আশঙ্কায় পালিয়ে আসা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব বিষয়টিকে কোনও উল্লেখ ছিল না। দিল্লি ও গুয়াহাটির কি সূত্র জানাচ্ছেন, এ বার নতুন করে যে বিল আনা হবে তাতে এই বিষয় গুলোর সরাসরি উল্লেখ থাকবে। যেহেতু আফগানিস্তানের সঙ্গে সরাসরি কোনও দেশভাগের মত ঘটনা ঘটেনি, তাই এবার প্রতিবেশী এই মুসলিম রাষ্ট্রটির উল্লেখ থাকছেনা। তবে পুরনাে বিলটির মতই এ বারও শরণার্থীদের ঢালাও নাগরিকত্ব দেওয়ার সরাসরি কোনও সংস্থান থাকছেনা। আইনিকারণেই তা সম্ভব নয়। পরবর্তীতে আবেদনের মাধ্যমে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। প্রস্তুতি পর্ব সেরে রাখলেও অযোধ্যা মামলার রায় অবধি অপেক্ষা রহে কেন্দ্রের শাসক দল। এর জন্যই অসমের এনআরসি নিয়ে এখনও কোনও হেলদোল নেই সরকারের। সুপ্রিম কোর্টের রায় মন্দিরের পক্ষে গেলেই নাগরিকত্ব বিল ও এনআরসি নিয়ে পুরােদমে অভিযান শুরু করবে বিজেপি সরকার।
অযােধ্যা মামলার শুনানি যেভাবে এগােচ্ছে তাতে মন্দিরের পক্ষেই রায় আসবে বলে আইনি মহলের ধারণা। দিল্লির একটি সূত্র জানান, এটা আঁচ করেই মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের একটি মঞ্চ অযােধ্যার বিতর্কিত জমি হিন্দুদের উপহার দেওয়ার প্রস্তাব এনেছে। অযােধ্যা মামলার রায় মন্দিরের পক্ষে গেলে বিজেপি সংঘ পরিবারের দীর্ঘদিনের দাবি পূর্ণতা পাবে ঠিকই, কিন্তু ভোটের বাজারে বিজেপির হাত থেকে একটি বড় ইসও সরে যাবে। এই শূন্যস্থান পূরণের জন্যই সারা দেশে এনআরসি-র ডাক দিয়ে ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের কুচকাওয়াজ শুরু করতে চাইছে বিজেপি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অসমের এনআরসি গেরুয়া শিবিরকে চাপে ফেলে দিয়েছে। এনআরসির চূড়ান্ত তালিকায় দেখা গেছে যে ১৯ লক্ষের নাম বাদ গেছে তার মধ্যে বাঙালি হিন্দুর সংখ্যা প্রচুর বেশি, সে তুলনায় মুসলিমের নাম অনেকই কম। এমনটাই যে হবে সেটা সংঘ পরিবার ভালই জানত, এবং জানত বলেই কেন্দ্রে বিজেপি সরকার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসার পরপরই প্রেম জোড়া নােটিফিকেশন ও পরে নাগরিকত্ব সংশােধনী বিল এনে হিন্দু উদ্বাস্তুদের এ দেশে নির্বিঘ্নে বসবাস নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু কেন্দ্রের এই দুটো পদক্ষেপের বিরুদ্ধে অসম ও পরে গোটা উত্তর পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি রাজ্যগুলোয় ব্যাপক প্রতিবাদ শুরু হয়। কিছু দিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গুয়াহাটিতে উত্তর-পূর্ব মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এক বৈঠকে বসেছিলেন। সেখানে মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা, মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা বিলের বিরােধিতায় সরব ছিলেন। ফলে এ বার আটঘাট বেঁধেই মাঠে নামছে শাহের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ।
সপ্তমীর দিন আইজল গিয়েছিলেন অমিত শাহ। সেখানে ছি লন অসমের প্রভাবশালী মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মাও। আজকেৰ বিরোধী নেতাদের শাহ বুঝিয়েছেন, নতুন বিলে সরাসরি ধর্মীয় নির্যাতনে'র শিকার হয়ে যেসব অমুসলিম এ দেশে এসেছে শুধু তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়টি থাকবে। মুসলিমদের কোনওভাবেই নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না। তাছাড়া এ বার বিলে স্পষ্টভাষায় ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার ও দেশভাগের বলি এ সব উল্লেখও থাকবে। এবং এর জন্যই আফগানিস্তানকে এ বার বিলের বাইরে রাখা হবে। উত্তর পূর্বের অন্য পাহাড়ি রাজ্যগুলাের মুখ্যম্মীদের বােঝানাের দায়িত্ব হিমন্ত বিশ্ব। সূত্রটি জানান, পাহাড়ি রাজ্যগুলােতে বাঙালি মুসলিম নিয়েই উদ্বেগ বাড়ছে। মিজোরামের মত রাজ্য যেখানে যেতে গেলে ইনার লাইন পারমিট নিতেহয় সেখানেও মুসলিমের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে।
এমন কী ত্রিপুরায়ও বাড়ছে বাঙালি মুসলিমরা। ত্রিপুরার ক্যাব বিরােধী এক নেতা বলেন, পার্বত্য এলাকায় মুসলিম মেয়েরা এখন বােরখা তৈরি করছেন পাহাড়ি মেয়েদের পরস্পরাগত চাদর দিয়ে। এটা তাদের স্বাভিমানে আঘাত করেছে। এক কথায় বিজেপির হিন্দু কার্ড উত্তর পূর্বের ট্রাইবাল জনগােষ্ঠীর মধ্যে খেলানাের মত পরিস্থিতি বিজেপি তৈরি করে ফেলছে। এ ক্ষেত্রে অসমে ভোটের ফল বিজেপির কাছে রীতিমত উৎসাহব্যঞ্জক। "হিন্দু বাংলাদেশিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার চেষ্টা করছে বিজেপি, এই অভিযােগ এনে ক্যাবের ব্যাপক বিরােধিতা করেছিল অসমিয়া জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলাে। কিন্তু ভোটের বাজে এর আঁচড়টুকুও পড়েনি, বিজেপি হেসেখেলে জিতেছে। বরং ক্যাকের বিরোধিতার খেসারত দিতে হয়েছে কংগ্রেস। সংসদে ক্যাব যাতে নির্বিঘ্নে পাশ করিয়ে নেওয়া যায়, এর ছকও সাজিয়ে রেখেছে বিজেপি। গত দফায়ও অসম বাদ দিলে কংগ্রেসের অন্য রাজ্যের সাংসদরানীতিগতভাবে হিন্দু শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার খুব বিরােধী ছিলেন না।
দিল্লির একটি সূত্র জানান, এ বার তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও মােটামুটি রফা হয়ে গেছে বিজেপি নেতৃত্বের। প্রাথমিক কথাবার্তায় ঠিক হয়েছে, শীতকালীন অধিবেশনে বিল আনা হবে এবং যদি ভােটাভুটি হয় তা হলে তৃণমূল সাংসদরা বয়কট করে বেরিয়ে আসবেন। মমতা কিছুদিন আগে দিল্লি গিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার একান্তে কথাও হয়েছে। সেখানে এ বিষয়টি উঠেছিল কি? সূত্রটি বলেন, এটা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল, তবে মুখ্যমন্ত্রীর দিল্লি সফরের পরই সারদা মামলায় ‘ফেরার’ পুলিশ কর্তারাজীবকুমার প্রকাশ্যে আসেন। তৃণমূল ভাঙানাের প্রধান কারিগর মুকুল রায়কে জেরা করেছে সিবিআই। সূত্রটির ইঙ্গিত, কোনও অবস্থাতেই মমতার ভাইপো সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কে জেরা করে সিবিআই। অপর এক সূত্রে জানা গেছে, হিমন্ত বিশ্ব শৰ্মা আইজলে অমিত শাহ-র সফর সেরে পুজোর দু'দিন শিলচরে ছিলেন।
নবমীর সকালে শিলচরের প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ সুস্মিতা দেবের বাড়ির পুজোয় গিয়েছিলেন নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। ওই সময় তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, চূড়ান্ত এনআরসি বাতিল করা হবে। এবং নতুন করে ফের এনআরসি হবে। বিভিন্ন সুত্রে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, সারা দেশের সঙ্গে অসমেও ফের এনআরসি করানাে হতে পারে। এর আগে ক্যাব পাশ হয়ে গেলে হয়ত ভিত্তিবর্ষ ১৯৫১ সালকে ধরা হবে। ১৯৫১-এর নথি দেখাতে পারবেন না দেশভাগের শিকার অনেক বাঙালি। হিন্দু বাঙালি। মুসলিম বাঙালি। কিন্তু ক্যারে সৌজন্যে হিন্দুরা ছাড় পেয়ে গেলে সেক্ষেত্রে এনআরসি থেকে মুসলিমদের সংখ্যা অনেক বেশি বাদ পড়বে। মােটামুটি এই অংক মাথায় রেখেই প্রস্তুতি পর্ব সেরে রেখেছে বিজেপি। বাকিটা নির্ভর করছে অযোধ্যা রায়ের ওপর।
No comments:
Post a Comment