নিজস্ব প্রতিনিধিঃ চতুর্দশ শতাব্দীতে সর্বানন্দসুরী নামে এক আচার্য পণ্ডিতের তালপাতার পুথি, ‘দীপোৎসবকল্প’ থেকে জানা যায় জৈন ধর্মের অন্যতম মহাপ্রচারক মহাবীর বর্ধমানের মহাপ্রয়াণের পর তাঁর অন্যতম অনুগত সঙ্গী রাজা নন্দীবর্ধন মানসিক এবং শারীরিক ভাবে খুবই ভেঙে পড়েন। বন্ধ করে দেন খাওয়াদাওয়াও। এইরকম অবস্থায় তাঁর প্রিয় বোন অনসূয়া নন্দীবর্ধনকে তাঁর নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। দিনটি ছিল কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথি। রাজার কপালে রাজতিলক পরিয়ে বোন অনসূয়া ভাইকে কিছু খাবার খাইয়ে দেন, আর বলেন, “রাজ্যের প্রজারা তোমার দিকে তাকিয়ে আছে, এই অনশন তোমাকে মানায় না। হে ভ্রাতা, হে রাজন, রাজতিলক এঁকে দিলাম তোমার কপালে এবং ক্ষুধা নিরসনের জন্য গ্রহণ করো খাদ্য। তুমি সাদর আপ্যায়িত হও। সর্ববিধ মঙ্গলের জন্য তুমি জেগে ওঠো, ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। তোমার দীর্ঘায়ু কামনা করি। প্রতি বছর এইদিনে তোমাকে রাজতিলক পরিয়ে অভিষিক্ত করা হবে, এই আমার ব্রত।” এরপর বোনের দেওয়া খাবার খেয়ে এবং বোনের মুখে এই কথা শুনে রাজা নন্দীবর্ধন অনশন ভেঙে জীবনসত্যে উদ্ভাসিত হয়েছিলেন।
‘দীপোৎসবকল্পে' বর্ণিত এই ইতিহাস আর কাহিনি যদি সত্যি হয়, তা হলে সেই সূত্র ধরে আমরা ‘ভাইফোঁটা’ উৎসবের সময়কাল আন্দাজ করতে পারি। মহাবীরের মহাপ্রয়াণ ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫২৭ অব্দে। সেই হিসেবে এই উৎসবের বয়স আড়াই হাজার বছর।
এ ছাড়াও পুরাণ, বেদ, উপনিষদ সহ বিভিন্ন গ্রন্থে আমরা সূর্যদেবের কথা জানতে পারি। ‘মৎস্যপুরাণ’-এ সূর্যদেবের উল্লেখ আছে। সেখানে কশ্যপ মুনি এবং অদিতির পুত্র। তাঁর আরেক নাম বিবস্বান। সূর্যদেবের তিন পত্নী – সংজ্ঞা, প্রভা ও রজনী। সংজ্ঞা ও সূর্যদেবের দুই পুত্রের নাম মনু আর যম। আর কন্যা যমুনা। ওই সুপ্রাচীন গ্রন্থমতে, মনুর উত্তরসূরিরাই মানুষ।
পরবর্তীকালে যমুনার সাথে বিয়ে হয় শ্রীকৃষ্ণের অগ্রজ বলরামের। দিনটি ছিল সেই কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথি। বিয়ের আগে ভাইদের কপালে ফোঁটা দিয়ে তাঁদের মঙ্গলকামনা করেছিলেন যমুনা। সেই থেকেও হতে পারে ভাইফোঁটার প্রচলন।
এটা ঠিক, যে ভাইফোঁটার ব্রত বা উৎসবে যমের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি আমরা লক্ষ্য করি। বলা যায়, যমের হাত থেকে ভাইদের রক্ষার জন্যই ভাইদের মঙ্গলকামনা করে থাকেন বোনেরা। বাংলার বাইরেও সারা দেশ জুড়েই পালন করা হয় ভাইফোঁটা। কোথাও তার নাম ‘ভাইটিকা’, কোথাও ‘ভাইদুজ’, কোথাও আবার ‘ভাই বিছিয়া’। মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, উত্তরাখণ্ড, ছত্তিশগড়, হিমাচল প্রদেশ, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, গোয়ায় চালের গুঁড়ো দিয়ে আলপনা দেওয়া হয়, যাকে চৌকনা, চতুর্কোন, চোকনা বা চুকনা বলা হয় অঞ্চলভেদে। আলপনার নির্দিষ্ট জায়গায় ভাইকে বসিয়ে বোনেরা দিদিরা তাদের ভাইদের নরকাসুর বধকারী শ্রীকৃষ্ণ রূপে পুজো করে, কপালে চন্দনের তিল্কা বা তিলক পরিয়ে আরতি বা আর্তি করে।
ভাইবোনের এমন পবিত্র সুন্দর সম্পর্কের অনুষ্ঠান সুপ্রাচীনকাল থেকে বৃহত্তর ভারতবর্ষে প্রচলিত, যার ঐতিহ্য ও পরম্পরা আজও বর্তমান।কথিত আছে, এইদিন নাকি শ্রীকৃষ্ণ নরকাসুর বধ করেছিলেন। পূর্ব ভারতের অসম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, ওড়িশা, এমনকি দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জায়গায়, বাংলাদেশ, নেপালেও পালন করা হয় এই উৎসব। নেপালের রীতিটা একটু অন্যরকম। ভাইরা যখন ঘুমিয়ে থাকেন, বোনেরা ভাইয়ের কপালে পরিয়ে দেন পোড়া চালের ফোঁটা, উদ্দেশ্য অশুভ শক্তির হাত থেকে ভাইকে বাঁচানো। ‘ভাইফোঁটা’কে নেপালের কোথাও কোথাও ‘ভাইলগন’ বা ‘ভাতিলগন’ বলা হয়।
প্রসঙ্গ শেষে বলা যেতেই পারে, ভাইফোঁটা আমাদের এক সুপ্রাচীন রীতি। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে উদ্যাপিত হয় এই উৎসব। স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবীদের গোপন আস্তানায় পালিত হত ভাইফোঁটার ব্রত।
পি/ব
No comments:
Post a Comment