কুচি কাঠির মা সুরুলে - pcn page old

Post Top Ad

Post Top Ad

Wednesday, 2 October 2019

কুচি কাঠির মা সুরুলে




 দেবশ্রী মজুমদারঃ    কুচি কাঠির মা হিসেবে আরাধ্যা উমা সুরুলের পাল বাড়িতে।  ছোট বেলায় খেলাচ্ছলে মুড়ি ভাজার কুচি কাঠি দিয়ে এক ফুটের মৃণ্ময়ী মা দুর্গা, সরস্বতী, লক্ষ্মী, কার্তিক, গণেশ, মহিষাসুর তৈরী করে রাজসিক পূজার প্রচলন করেন মৃৎ শিল্পী রবীন্দ্রনাথ পাল। কিন্তু এযেন  উমা এল গরীবের ঘরে!   



এই পুজার আরেকটি বিশেষত্ব আছে! সুরুল জমিদারি এস্টেটের বড় তরফ ও ছোট তরফের পূজা বনেদি ঘরাণার। কিন্তু বড় তরফ সরকার বাড়ির কূল পুরোহিত নিজে এসে গ্রামের ৯টি পুজোবাড়িতে নিমন্ত্রণ করেন ডাব ও এক ঘড়া গঙ্গা জল নিয়ে আসার জন্য। এই রীতি চলে আসছে বরাবর।  ষষ্ঠীর দিন নিমন্ত্রিত নয় বাড়ি যায় বড় বাড়িতে।  সেখানে দেওয়া হয় ঘটভরা ইত্যাদি বিষয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ ও পূজার সূচী।  তারপর সুরুলের নতুন পুকুরে ১০ বাড়ির ঘট ভরে চতুর্দোলা সমারোহে  ঘাট থেকে সুরুল বাড়ি পর্যন্ত শোভাযাত্রা  দেখার মতো।                     



জানা গেছে,  আনুমানিক ৭৫ বছর পূর্বে সুরুল গ্রামের পাল বাড়িতে এই দুর্গাপুজা শুরু করেন স্বর্গীয় রবীন্দ্রনাথ পাল (স্বর্ণকার)। তখন তিনি খেলার ছলে কুঁচির কাঠি তে মাটি পাকিয়ে এক ফুটের এক প্রতিমা বানিয়ে বাড়িতেই পুজা করেন। এই পুজা ব্যক্তিগত ভাবে করলেও পাড়ার বিশিষ্ঠজনদের সহযোগিতা পেয়েছিলেন।  উনি নিজেই একজন ভালো মৃৎশিল্পী ছিলেন। নিজে হাতেই প্রতিমা গড়তেন।



তাই তৈরীর খরচ লাগতো না। পাড়ার ব্রাহ্মণ স্বর্গীয় আদিত্য নাথ চক্রবর্তী এই পুজা বিনা পারিশ্রমিকে করে দিতেন। এমনকি নিজের বাড়ি থেকে কাপড় গামছা নিয়ে এসে পুজা করতেন। ২০০৮ সালে উনার মৃত্যুর পর তিন ছেলে ও তিন মেয়ে মিলে এই পুজা চলতে থাকে।  বর্তমানে দীর্ঘদিন ধরে পাল বাড়ির পক্ষে বামাচরন পাল এই পুজার পরিচালনা করেন। এই দেবীর কোনো সম্পত্তি নেই। একমাত্র মনের জোরে ও ভক্তির আতিশয্যে এই পুজা চলছে।  বহু গুণী  মানুষের ত্যাগ, আন্তরিক ভালোবাসায় আজ  এই পুজা  বিরাট আকার ধারণ করেছে, বলে জানা গেছে।     



বামা চরণ পাল পেশায় বিশ্বভারতীর গ্রহ্নাগার বিভাগে চাকুরীরত এবং চিত্রগ্রাহক। তিনি বলেন,  কুচির কাঠি দিয়ে খেলাচ্ছলে প্রথম কয়েক বছর বাবা ঠাকুর তৈরী করেছিলেন। বর্তমানে রাজকীয় ভাবে চলে।  মুড়ি ভাজার কুচি কাঠির উপর মাটি দিয়ে ছোট ছেলেরা যেমন প্রতিমা তৈরী করে, তেমনি বাবা তৈরী করেছিলেন।  কুচির কাঠির উপর মাটি দিয়ে  হাত পা তৈরী করতেন। এখানে কুচি কাঠি অবলম্বন হিসেবে মাটিকে ধরে রাখতো। মূর্তি হত এক ফুট দৈর্ঘ্যের।  বাবার মূর্তি গড়া শেখা আদিত্যনাথ চক্রবর্তীর কাছে।



তিনিই পূজা করতেন। অর্থাৎ পুরো পূজাটা ছিল অর্থ সম্পর্ক রহিত, আন্তরিকতা পূর্ণ। সপ্তমীর দিন বাড়িতে শ’দুয়েক লোকজন বাড়িতে খাওয়ানো হয়। পাড়ার কচিকাচা, আত্মীয় স্বজন, সহকর্মীদের নিয়ে শ’দুয়েক লোকের খাওয়ানো হয়। ভাত ডাল পোস্ত, মাছ চাটনি পাঁপড় মিস্টি পাত পেড়ে খাওয়ানো হয়। ছোট দুর্গা পূজা আস্তে আস্তে বড় আকার ধারণ করেছে। বড় বাড়ির তরফে আমাদের মত গরীবদেরও সম্মান জানিয়ে জমিদারি এস্টেটের কূল পুরোহিত আমাদের নিম্নত্রণ করে যান। আমরা কিন্তু বনেদি নয়, গরীব। তবুও আমাদের সম্মান দেয়। একটা ডাব ও এক ঘড়া গঙ্গা জল নিয়ে আসার জন্য।  সেখানে অনুষ্ঠান সূচী দেয়।



ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যেয় আমরা বড় বাড়ি যায়। সেখানেই বলে দেওয়া হয় কখন দোলা নিয়ে যাওয়া হবে ঘটে বারি ভরার জন্য।  ১০টা পুজো বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে ব্রাহ্মণ। নব পত্রিকা স্নান করায় ১০ ঠাকুর স্নান সুরুলের নতুন পুকুরে।  পুকুর ঘাট থেকে বড় বাড়ি পর্যন্ত একটা শোভা যাত্রা হয়। পাড়ার বিশিষ্ট ব্যক্তি প্রয়াত হলধর দাস, প্রয়াত শক্তিপদ সাহা, প্রয়াত জীবানন্দ বাবু, প্রয়াত লক্ষ্মী নারায়ণ সিংহ প্রমুখরা এই পুজোয় সাহায্য করেন।  বাবা রবীন্দ্রনাথ পাল একজন খুব ভালো মৃৎ শিল্পী ছিলেন।



  তিনি গ্রামের তিনটি দুর্গা মূর্তি গড়তেন। তিন বোন অনুরাধা, অনুরূপা, অনুপমা। শ্যামাচরণ, বামা চরণেরা মিলে দেখতেন বাবার মূর্তি গড়া। তবে মূর্তি গড়তে শিখেছিলেন বামা চরণ পাল, তাঁর বড়দি আর ভাই! বর্তমানে বেশ কয়েক বছর ধরে মূর্তি তৈরী করেন সুভাষ সুত্রধর। অনেকদিন ধরেই  সুরুলের সরকার বাড়ির বড় তরফের মূর্তি তৈরী করেন তিনি। বামাচরণ পাল জানান,  সময়ের অভাবে,  সুভাষ সূত্রধরকে প্রতিমা তৈরীর দায়িত্ব দিয়েছি।  ১০ বছর ধরে সুভাষ সূত্রধর আমাদের পছন্দের মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করে আসছেন।



পি/ব

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad