দেবশ্রী মজুমদার: এক গুচ্ছ বিস্ময় অপেক্ষা করে আমার আপনার জন্য শান্তি নিকেতনের সোনাঝুড়ির জঙ্গলের দুর্গা পুজোয়। এখানে দেবী দুর্গা মৃণ্ময়ী নয়, চিন্ময়ী। তাই কোন আদিবাসী, এমনকি কোন মানবীর মুখ খুঁজতে যাওয়ার চেষ্টা বৃথা। এখানে দেবী লোহার মূর্তি। তাতে আছে শিল্পীর সত্বা। ২০১৫ সালে ঠিক একই ভাবে এই লোহার মূর্তি করেছিলেন শিল্পী। আরেক অবাক বিস্ময় হল এখানে দেবী দশপ্রহরণধারিণী নন, হাতে তাঁর পদ্মের কুঁড়ি। ইরাক- আমেরিকা দ্বৈরথ থেকে পৃথিবীর সমস্ত হিংসাশ্রয়ী যুদ্ধ বাজদের বিরুদ্ধে এখানে চলে শিল্পীর এক নিরব প্রতিবাদ। তাই প্রতিমার হাতে কোন অস্ত্র নেই, আছে পদ্মের কুঁড়ি।
যা চিত্ত শুদ্ধির প্রতীক। তাই এ এক অন্য দুর্গা পুজো। কখনও পোড়া মাটি আবার কখনও টেরাকোটার মূর্তি। এবার লোহার। ধাতব লোহার পাতের উপর মূর্ত অনন্য দুর্গা প্রতিমা। জেলায় আদিবাসীদের একমাত্র পুজো সোনাঝুড়ি জঙ্গলে এই মূর্তি দেখা যাবে দেবী দুর্গার। এই পুজোর প্রবর্তন কবে হয়েছিল, তা জানতে একটু পিছনে হাঁটতে হবে। বোলপুর শহরের বিশ্বভারতী লাগোয়া বনেরপুকুর ডাঙা ও বল্লভপুর ডাঙা এই দুই আদিবাসী গ্রামের মাঝখানে সোনাঝুড়ির জঙ্গলে পুজোর আয়োজন করেছিলেন কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের অধ্যাপক তথা বিশ্ব বিখ্যাত শিল্পী বাঁধন দাস।
তাঁর ভাবনা ছিল শহর থেকে দূরে আদিবাসীদের নিয়ে একটু অন্যরকম দুর্গাপুজোর আয়োজন করার। এই জঙ্গলে পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করেন শিল্পী বাঁধন দাস। ২০০১ সালে সেই পুজোর প্রবর্তন করেন তিনি। ২০০২ সালে শিল্পী মারা যান। তারপর টানা ১৪ বছর আদিবাসীদের নিয়ে পুজো চালিয়ে যাচ্ছেন শিল্পী বাঁধন দাসের সম্বন্ধী ও তাঁরই হাতে গড়া ছাত্র আশিষ ঘোষ। তিনি (আশিষবাবু) কোলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে ১৯৮৪ সালে চিত্রকলা ও ভাস্কর্য্য নিয়ে স্নাতক হন। বাঁধন দাসের মৃত্যুর পর তিনি এই পুজো চালিয়ে এলেও, আজও এই পুজো বাঁধন দাসের পুজো নামে খ্যাত।
কুমোরটুলির ঘরানা থেকে বেড়িয়ে তাঁর মানস প্রতিমা দুর্গায় শিল্পী বাঁধন দাস তুলে ধরেন প্রাচীন কলার অতিবাস্তবতা। শিল্পীর ভাবনায় মূর্তির চোখ, মুখ মানবীয় হবে না। তাই তাঁর তৈরী প্রতিমায় কোন সাঁওতালি নারী বা পুরুষের আদল খুঁজতে যাওয়া বৃথা। শিল্পীর ভাবনায় তিনি মানুষেরও উর্ধ্বে। যাকে কলার ভাষায় বলা হয় সুপার রিয়ালিজম বা অতিবাস্তবতা। শুধু তাই নয়, এক সময় ইরাকের উপর আমেরিকার হানা তাঁকে ব্যথিত করেছিল। তাই তিনি তাঁর প্রতিমার হাতে কোন অস্ত্র দেন নি। তার বদলে দেবীদের হাতে দিয়েছেন পদ্মের কুঁড়ি। কারন তিনি মনে করতেন যুদ্ধ কখনও বিকল্প পথ হতে পারে না।
আরো অন্য পথ আছে। এই ভাবনার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে এই পুজোয় হয় না কোন বলি। এই পুজোয় কোন চাঁদা নেওয়া হয় না। গ্রামের মানুষের সাহায্যে চলে আসছে এই পুজো। আটচালার মধ্যে হয় এই পুজো। গ্রামের মানুষ সর্বত ভাবে অংশ গ্রহণ করেন এই পুজোয়। পুজোর একদিন আদিবাসীরা এখানে খিঁচুড়ির পঙক্তি ভোজন সারেন চরম তৃপ্তিতে। এবার প্রতিবেশী বিহার ও ঝাড়খণ্ড থেকে আদিবাসীদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দল আসবে পুজো তিনদিন বিভিন্ন অনুষ্ঠান করতে। প্রতিবার নূতনত্বের ছাপ থাকে শিল্পী আশিষ ঘোষের ভাবনায়।
২০১৪ সালে ফাইবার আর কাঠ দিয়ে মূর্তি তৈরী করেন তিনি। আদিবাসীরা শুধু পুজোর চারদিন নয়, প্রায় দেড় মাস ধরে কাঠ আর ফাইবার দিয়ে মণ্ডপ সাজাতে শিল্পীর সঙ্গে হাত লাগিয়েছিলেন আদিবাসীরাই। এবারও তার ব্যতিক্রম হয় নি। প্রতিবছর চমক থাকে এই পুজোয়। কোনবার কাঠ তো কোনবার লোহার মূর্তি। প্রথমবার মূর্তি গড়ার কাজে হাত লাগিয়েছিলেন শিল্পী বাঁধন দাস নিজেই। তারপর থেকে মূর্তি তৈরী করে আসছেন শিল্পী আশিষবাবু। ২০১২ সালে বাঁশের মূর্তি তৈরী করেন শিল্পী।
এমনিতেই শরৎ ঋতুতে আদিবাসীরা বেল বরণ উৎসবে মেতে ওঠে। সেই সঙ্গে শারদ উৎসব হিসেবে দুর্গা পুজো উপভোগ করতে হলে আসতে হবে সোনাঝুড়ির জঙ্গলে। শুধু পুজোর আনন্দ নয়, আদিবাসী সংস্কৃতির ছোঁওয়া পাওয়া যাবে এখানে। সোনাঝুড়ির জঙ্গলে দেখা মিলবে মাদলের তালে তালে আদিবাসী নারী ও পুরুষের সারিবদ্ধ নাচ। এবার তো আনন্দের মাত্রা আলাদা। দুমকা ও বিহার থেকে আসছে আদিবাসীদের বেশ কয়েকটি সাঁওতালি সাংস্কৃতিক দল।
পি/ব
No comments:
Post a Comment