অখন্ড মেদিনীপুর জেলার প্রাচীন রথযাত্রা উৎসব গুলির অন্যতম পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুরের তিয়রবেড়িয়ার শ্রী শ্রী মদনগোপাল জিউর রথযাত্রা উৎসব। আজ থেকে প্রায় আনুমানিক ২১০ বছর আগেকার কথা। তখন অবিভক্ত মেদিনীপুর তথা অধুনা পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরের তিয়রবেড়িয়া গ্রামের জমিদার ছিলেন ত্রৈলোক্যনাথ সামন্ত। তাঁর উদ্যোগে শুরু হয় এই রথ যাত্রা উৎসব। যদিও ত্রৈলোক্যনাথ সামন্ত এই গ্রামের আদি বাসিন্দা ছিলেন না। তাঁর পিতা বলরাম সামন্তের হাত ধরেই সামন্ত পরিবারের এই গ্রামে আসা। তিয়রবেড়িয়া গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা হাঁড়া পরিবার কর্মসূত্রে ঘাটাল যেত, আর তাঁদের সঙ্গেই বলরাম সামন্তের আত্মীয়তা হয়। সেই সূত্রে ধরেই, এই সামন্ত পরিবার এই তিয়রবেড়িয়া গ্রামে আসে। এই সামন্ত পরিবার আগে ঘাটাল শহরের বাসিন্দা ছিল। ত্রৈলোক্য বাবুর জমিদারীর মূল আখড়া ছিল অবিভক্ত মেদিনীপুরে দূর্বাচটি নদীর দক্ষিণ তীরে মালিদা গ্রামে। তিয়রবেড়িয়ার রথযাত্রা উৎসবের রথে বিরাজ করেন জমিদার ত্রৈলোক্যনাথ সামন্তের কুল দেবতা শ্রী শ্রী মদন-গোপাল জিউ। মেলা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন স্থানীয় মেলা কমিটি।
এই রথের বয়স আনুমানিক ভাবে প্রায় একশোর বেশি। যার প্রকৃত কোনো হিসাব মেলেনি। আর মেলা ও মেলা কমিটির বয়সের হিসাবে এই বছর মেলার ৮৪ তম বর্ষে পা দিচ্ছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায় রথযাত্রা শুরুর প্রথম দিকে মেলা হত না। মেলা শুরু হয়েছে বেশ কিছু বছর পরে। এই রথযাত্রার মূল আকর্ষণ এখানকার রথ। এখানকার রথটি প্রায় আশি মণ পিতল দ্বারা লোহার কাঠামোর উপর নির্মিত। পাঁচ চূড়া যুক্ত এই রথের উচ্চতা কম বেশি প্রায় ২৫-২৬ ফুট। তিন ধাপে গঠিত এই রথ।সবার উপরে রয়েছে পাঁচটি মন্দির। চার কোণের মন্দিরে রয়েছে চার জন ঋষি এবং মাঝের মন্দিরের রত্ন বেদীতে অধিষ্ঠান করেন শ্রী শ্রী মদন -গোপাল দেব ও রাধারানী। মাঝের ধাপের চার কোণে রয়েছে চার জন নৃত্যরত পরী। রথের সম্মুখ ভাগে রয়েছে দুটো ঘোড়া এবং একজন সারথী। এই রথের সবার উপরের চূড়াতে রথের রক্ষক হিসাবে বিরাজ করছেন ভগবান বিষ্ণুর বাহন গরুড়দেব। তাই এই রথের নাম করন করা হয় গরুড়ধ্বজ। রথে লাল রঙের পাঁচটি পতাকা ব্যবহার করা হয়। পতাকার নাম চক্রধর। এখানে রথের সারথীর নাম সাত্যকী। রথের ৬টি চাকা রয়েছে। যা ষড় রিপুকে দমন করার প্রতীক হিসাবে ধরা হয়। রথে ব্যবহৃত সমস্ত মূর্তি গুলি সম্পূর্ণ নিরেট পিতল দ্বারা তৈরী। রথ তৈরির জন্য পিতল আনানো হয়েছিল ত্রৈলোক্য বাবুর কলকাতার নিজেস্ব দোকান থেকে।
মিস্ত্রিও আনা হয় কলকাতা থেকে। রথ নির্মাণ করতে প্রায় ৫ মাস সময় লেগে ছিলো। রথ থেকে মূল মন্দিরের দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার পশ্চিমে, ত্রৈলোক্য বাবুর নিজ বাস গৃহের নিকট। রথ যাত্রার আগের দিন রথকে ঘিরে হয় নেত্র-উৎসব অর্থাৎ রথ ঝাড়া পোঁছা। তারপর রথযাত্রার দিন সকালে, সুসজ্জিত পালকিতে করে, বাদ্য বাজনা ও শোভা যাত্রা সহকারে, শ্রীশ্রী মদন গোপাল জিউ ও রাধারানীকে আনা হয় রথের কাছে গুন্ডিচা মন্দিরে ( যদিও এখানে কোনো স্পেশাল গুন্ডিচা মন্দির নেই, ওই সামন্তদের প্রতিষ্ঠিত উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি কক্ষকে গুন্ডিচা মন্দির বানিয়ে নেওয়া হয়)। ন’দিন ধরে চলে রথ যাত্রার পূজা। রথ যাত্রার প্রথম দিন সকালে মহাধুম-ধামে নব উপাচারে কুলদেবতার পূজা করে শুভ সময় দেখে রথ কে ঘর থেকে কিছুটা টেনে রথ যাত্রার শুভ সূচনা করা হয়। রথের রশিতে প্রথম টান দেন প্রতিষ্ঠা পরিবারের পক্ষ থেকে যিনি পূজার ব্রতী থাকেন। ফের আবার বিকেলে রথকে মেলার চার পাশে তিনবার প্রদক্ষিণ করানো হয়। উল্টো রথের দিনও নিয়ম ঠিক একই। এই ভাবেই টানা হয় তিয়রবেড়িয়ার আশি মন পিতলের রথ। উল্লেখ্য, এখানে বেশ কিছুটা লম্বা পথ ধরে রথযাত্রা হয় না।রথ যেটুকু টানা হয় তা মেলাকে কেন্দ্র করেই। রথ যাত্রা শেষ দিন যখন মদন-গোপাল জিউ পালকিতে করে বাড়ি ফেরেন, তখন তিনি মাসির দেওয়া খই চড়া ছড়াতে ছড়াতে বাড়ি ফিরে যান, আর তার বাড়ি ফেরার জন্য অপেক্ষা করে গোটা সামন্ত পরিবার। পূর্বের প্রথা অনুযায়ী রথ টানার আগে কামান ফাটানো হত।যা আজ থেকে তিন দশক আগে কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। রথের দিন শ্রীশ্রী মদন গোপাল জিউ ও রাধারানীকে সাজানো হয় স্বর্ণালঙ্কারে রাজ বশে। এখানে মদন-গোপাল জিউ মনে রাধা কৃষ্ণের যুগল মূর্তি, কৃষ্ণ এখানে কষ্টি পাথর নির্মিত এবং রাধা মূর্তিটি সম্পূর্ন অষ্টধাতুর তৈরি। ত্রৈলোক্য নাথ বাবুর কুল দেবতার পায়ে নুপুর থাকার জন্য, তাঁর পরিবারের কোনো কুল বধূ পায়ে নুপুর পরেন না।
শুধু রথ যাত্রা নয়, সারা বছর ধরেই মদন-গোপাল জিউর বিভিন্ন উৎসব পালন করা হয়। যেমন:- জন্মাষ্টমী, রাসযাত্রা (রাসের জন্য আলাদা করে রাসমঞ্চ আছে), চাঁচর, দোলযাত্রা, শয়ন একাদশী, পার্শ্ব একাদশী, উত্থান একাদশী ও ভীম একাদশী এবং সবচেয়ে বড় উৎসব রথযাত্রা। এছাড়াও প্রতিদিন সকালে- সন্ধ্যা পূজা হয়। সকালে ৬০০ গ্রাম আতপ চাল ও পান দিয়ে এবং সন্ধ্যায় মিষ্টান্ন দিয়ে ভোগ দেওয়া হয়। এই দায়িত্ব আজও পালন করে আসছে তিয়রবেড়িয়া গ্রামের সামন্ত পরিবার। এই রথ নিয়ে লোক মুখে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। লোক মুখে শোনা যায়, পূর্বে নাকি এই রথ তৈরি হয়ে ছিলো কাঠ দিয়ে, এক বছর রথযাত্রার সময়, রথ টানার পর ব্রাহ্মণরা রথ থেকে মদন-গোপাল জিউকে না নামিয়ে রথেই রেখে চলে যান, তার পর রাত্রে নাকি রথ এমনি এমনি চলতে শুরু করে এবং সেই সঙ্গে নাকি মদন-গোপাল জিউর পায়ের নপুরের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। শোনা যায় তারপর নাকি মেলা প্রাঙ্গনের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত সামন্তদের প্রতিষ্টা পুকুরে পড়ে যায়। যার খোঁজ নাকি আজও পাওয়া যায়নি।
তাই নাকি আজও রথ টানার সময় ওই পুকুরের কাছে রথ এলে, খুব সাবধানে টানা হয়, লোক মুখে শোনা যায়, পুকুর নাকি রথকে নিজের দিকে টানতে থাকে। তারপর নাকি আজকের এই পিতলের রথের সৃষ্টি হয়। এই কাহিনী আজও দর্শনার্থীদের মুখে শোনা যায়। যদিও রথের প্রতিষ্টা পরিবার এই তথ্য ভিত্তি হীন বলে দাবি করেছেন। রথ যাত্রার দিন আগত ভক্তরা ভগবানের উদ্দেশে মোয়া ও রথ পূজা দেন ও মোয়া ছোড়েন। একবার রথের রশি টানতে দূর দূরান্ত থেকে ভক্তদের সমাগম ঘটে। ন’দিন ব্যাপী চলে এই মেলা। নানা রকম দোকান-দানী ও প্রচুর জনসমাগমে এক অন্য রকম রূপে সেজে ওঠে মেলা প্রাঙ্গন। পূর্বে এই মেলার আকর্ষণ ছিল পুতুল নাচ ও কবি গানের তরজা, যা এখন অতীত। সামগ্রিক জিনিস হিসাবে, তিয়রবেড়িয়ার মেলার বিখ্যাত জিনিস ছিল তালপাতার পেখা ও চারা গাছ। অন্যান মেলার থেকে এই রথের মেলাতে চারা গাছের বেচা কেনা সব চেয়ে বেশি হয়।তাছাড়া থাকে অন্যান দোকান দানী। মেলার নয় দিন মেলাতে মানুষের ভিড় থাকে চোখে পড়ার মতো। এক কথায় তিয়রবেড়িয়ার আশি মন পিতলের রথ ঘাটলের অহংকার।………….বি.দ্র.যাঁরা এই রথ বা রথের মেলা দেখতে চান তাঁরা নীচের ঠিকানা ও পথ নির্দেশ মেনে যেতে পারেন।
pb
No comments:
Post a Comment