ভয়ঙ্কর কিছু ঘটিয়ে দেয়ার শয়তানি শক্তি! - pcn page old

Post Top Ad

Post Top Ad

Saturday, 15 June 2019

ভয়ঙ্কর কিছু ঘটিয়ে দেয়ার শয়তানি শক্তি!

সংগীতকে মানুষের সুখানুভূতি জাগ্রত করার একটি কৌশল বলে মনে করা হয়। এমন অনেক সংগীত আছে যা শুনলে নিশ্চিত যেকারো অন্তরে অনুরণন সৃষ্টি হয় এবং অনেকে এতোটাই অভিভূত হয়ে যায় যে মাথা দোলাতে শুরু করে। অন্যরকম সুখানুভূতি বয়ে যায় শরীর মন জুড়ে।
তবে গানের যেমন সুখানুভূতি সৃষ্টিকারী ক্ষমতা রয়েছে তেমনি আছে উদ্দামতার আতিশয্যে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটিয়ে দেয়ার শয়তানি শক্তিও। গানের প্রভাবে যে কেউ করে করে ফেলতে পারে কোনো বাজে কাজ। এমনকি খুনও!
বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন ইসরায়েলের রিশন লে জিয়নের কলেজ অব ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাডেমিক স্টাডিজের মনোবিজ্ঞানী নাওমি জিভ। তিনি বলেন, বাস্তব জীবনে সংগীত বিভিন্নভাবেই মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। এর অনেক কিছু নেতিবাচকও হতে পারে।
সংগীত মানুষকে যেমন বিনয়ী করতে পারে, তেমনি আগ্রাসী ও বর্ণবাদী করে তুলতেও পারে বলে মনে করেন এই নারী গবেষক।
সংগীত মানুষকে পাশবিক হতে দেয় না, আরো বেশি মানবিক করে তোলে এমন ধারণাই প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, মার্কিন শিল্পী এমিনেম এবং মারলিম ম্যানসের মতো শিল্পীদের র‌্যাপ ও মেটাল সংগীতগুলো মানুষকে সহিংস আচরণে উদ্বুদ্ধ করে। একবার কলাম্বাইন হাইস্কুলে ম্যানসনের সংগীত শুনে দুইজনের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ উঠেছিল। যদিও পরে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
তবে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, হার্ড রক বা মেটাল সংগীত ক্রুদ্ধভাব জাগিয়ে তোলে। এ নিয়ে গবেষণা করেছেন জেনেভাইন ডিঙ্গল এবং তার সহকর্মীরা।
একটি হার্ডকোর মেটাল সংগীতের কনসার্টে যাওয়ার আগে গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের এমন একটি ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানাতে বলা হয়, যেখানে বন্ধু বা সহকর্মীরা তাদের ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। কনসার্টের পর দেখা যায়, যারা গান শুনতে গিয়েছিল তারা যারা যায়নি তাদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে।
ডিঙ্গল বলেন, ‘হার্ড রক ধরনের সংগীতগুলো শ্রোতাদের ক্রোধ বাড়িয়ে তুলতে পারে।’ 
তবে হার্ডকোর সংগীত নয় (ইজি লিসেনিং), এমন গান আরো বেশি বিপজ্জনক হতে পারে বলেও মনে করেন তিনি। উদাহরণ হিসেবে ২০১১ সালের একটি গবেষণার কথা বলেন ডিঙ্গল। সেখানে দেখা যায়, মানুষের নৈতিক মূল্যায়ন পাল্টে দেয়ার ক্ষমতা আছে সংগীতের।
ডিঙ্গল একদল মানুষকে একটি রেডিও বিজ্ঞাপন শোনালেন, যেখানে এমন একটি ওয়েবসাইটের বিষয়ে বলা হয়, যারা মিথ্যা নথি তৈরি করে বেশি অবসরভাতা পেতে সহায়তা করতে পারে। শ্রোতাদের অর্ধেক সংখ্যককে মোজার্টের ‘অ্যালেগ্রো ফ্রম অ্যা লিটল নাইট’ ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকসহ বিজ্ঞাপনটি শোনানো হয়। বাকিদের কোনো সংগীত ছাড়াই বিজ্ঞাপন শোনানো হয়।
একইভাবে আরেকটি দলকে একটি বিজ্ঞাপন শোনানো হয়, যেখানে সেমিনারে অংশগ্রহণকারীরা কীভাবে একটি ওয়েবসাইট ব্যবহার করে তাদের গবেষণাপত্র নকল করতে পারে তা শোনানো হয়। এখানেও অর্ধেক সংখ্যককে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে ব্রাউনের আই গট ইউ (আই ফিল গুড) শোনানো হয়।
উভয়ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যারা মিউজিকসহ বিজ্ঞাপন শুনেছেন তারা নকলে সহায়তাদানের কাজকে বেশি কঠোরভাবে অনৈতিক বলে মনে করেছেন।
‘সাইকোলজি অব মিউজিক’ নামের একটি জার্নালে প্রকাশিত আরো কিছু গবেষণায় একই ফলাফল পাওয়া গেছে। এতে জিভ এবং তার দল গবেষণায় অংশ নেয়া একটি দলকে ব্যাকরণ পরীক্ষার জন্য বেছে নেন। মিউজিক চালিয়ে তাদের একটি ব্যাকরণ পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। পরীক্ষা শেষে কাউকে উপকার করার জন্য বলা হয় তাদের। এদের মধ্যে কেউ জেমস ব্রাউনের গানটি শুনছিলেন। আর কেউ স্পেনীয় একটি নৃত্যের গান শুনছিলেন। তৃতীয় একটি দল কোনো সংগীতই শুনছিল না।
সংগীত চলা অবস্থায় গবেষকরা কিছু অংশগ্রহণকারীকে এমন একজন মেয়ে শিক্ষার্থীকে ডাকার জন্য বলেন যাদের কোর্স শেষ করার জন্য প্রয়োজনীয় ক্রেডিটের জন্য এই পরীক্ষায় অংশ নেয়া দরকার। অন্য অংশগ্রহণকারীদের বলা হয় এমন এক শিক্ষার্থীকে উপকার করতে, যে অসুস্থতার কারণে আগের সেমিস্টার পরীক্ষা দিতে পারেনি।
এদের মধ্যে যারা সংগীত শোনেনি তাদের বড় অংশই উপকারের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। আরো আশ্চর্যজনক হচ্ছে: এই দলের যারা অন্যের উপকার করতে চায়, তাদের যখন বলা হলো- এতে অন্য কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তারা উপকার করবে কি না? এখানে দেখা যায়, প্রথমবার উপকার করতে রাজি হয়েছিল ৬৫ শতাংশ। আর এই দ্বিতীয়বারে এসে অপরের ক্ষতি করেও উপকার করতে রাজি হয় ৮২ শতাংশ।
জিভ বলেন, ‘এটা রীতিমতো হতবুদ্ধিকর ব্যাপার। তাদের যখন বলা হলো, ওই উপকার অন্যের ক্ষতি করবে। এরপর তাদের অনেকেই তা করার জন্য রাজি হলো।’
তাহলে যারা ব্রাউনের সংগীত শুনছিল তাদের ক্ষেত্রে কী দাঁড়ালো? জিভ মনে করেন, এটা নির্ভর করে আমরা যখন খুশি হই তখন আমাদের ব্যক্তিত্ব কেমন হয় তার ওপর। তিনি বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, যখন আপনি ভালো মেজাজে থাকেন তখন বেশিরভাগ ব্যাপারেই একমত পোষণ করেন এবং সব কিছুকে কঠোরভাবে দেখেন না। হতাশ মেজাজে থাকা লোকজন সব কিছু বেশি বেশি চিন্তা করে দেখেন এবং সহজে কোনো কিছুতে রাজি হন না।
এই গবেষক আরো বলেন, ‘এক্ষেত্রে বড়দিনের সংগীত সবচে ভালো উদাহরণ। ওইসব সংগীত মানুষকে বেশি বিনয়ী করে তোলে।’
সংগীতের কিছু ফিচার আমাদের মস্তিষ্কের কাজের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে কাজ করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রিদমিক মিউজিক মানুষের আচরণ এবং চিন্তায় সঙ্গতি আনতে পারে। সিঙ্গাপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী অ্যানেট স্কিরমার জানান, সংগীত চলার সময় ড্রামে কোনো ছন্দ তৈরি মস্তিষ্কে সমতাল সৃষ্টি করতে পারে।
এটা বোঝার জন্য সবচে ভালো উদাহরণ বিভিন্ন উপজাতীগুলো যখন ড্রামের তালে তাল মিলেয়ে বড় বড় উৎসবে বিভিন্ন সমবেত নৃত্য করে বা সেনাবাহিনী যখন একসঙ্গে কুচকাওয়াজ করে। স্কিরমার বলেন, ‘ছন্দ একটি দলের মানুষকে এমনভাবে একত্রিত করে যে তাদের চিন্তা ও আচরণ সাময়িকভাবে সঙ্গতি স্থাপন করে।’
জিভ মনে করেন, ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা না করে এখনো এর প্রভাব সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু বলা যায় না। তবে এর প্রভাব গভীর বলেও মনে করেন তিনি। এই গবেষক বলেন, ‘আমি মনে করি, বাস্তবের দুনিয়ায় এটা অনেক বেশি চরমপন্থি হতে পারে।’
তিনি আরো বলেন, ‘সংগীত এক ধরনের দলবদ্ধ সংহতি এবং ঐক্য সৃষ্টি করতে পারে। মানুষ যখন একসঙ্গে কিছু করে তখন তাদের মধ্যে ঐক্য বেশি কাজ করে। এতে তাদের মধ্যে এক ধরনের দলগত চিন্তা সৃষ্টি হয়। নৈতিক মূল্যায়নে এটি তাদের মধ্যে অবক্ষয় তৈরি করতে পারে।’
মনকি এটা ভোট দেয়ার সিদ্ধান্তও পাল্টে দিতে পারে। রাজনীতিতেও সংগীতের ব্যবহার প্রচলিত। দলের মধ্যে আদর্শিক উৎসাহ সৃষ্টি এবং ঐক্য তৈরিতে এটা ব্যবহার করা হয়। একে বিশ্বাসযোগ্য বলে একমত পোষণ করেন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাস ব্যাপ্টিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জেসন ম্যাককয়।
নাৎসিদের উদাহরণ দিয়ে তিনি দেখান, রেডিওতে বিভিন্ন সংগীত বাজিয়ে কীভাবে তারা দলের প্রতি যুবকদের আকৃষ্ট করতেন। ঘৃণাত্মক সংগীতের মধ্য দিয়ে কীভাবে ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডা গণহত্যাকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিল সে বিষয়েও তার নিজের একটি গবেষণা রয়েছে।
দেশপ্রেমমূলক সংগীত এবং জাতীয় সংগীত কীভাবে একটি জাতির মধ্যে বর্ণবাদী আচরণ তৈরি করে এবং বিভক্তি সৃষ্টি করে- তা নিয়ে বর্তমানে গবেষণা করছেন ম্যাককয়। ইসরায়েলি সেনাদের জন্য ব্যবহৃত সংগীতগুলো কীভাবে তাদের মধ্যে ফিলিস্তিনিদের প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি করে, সে বিষয়েও কাজ করছেন তিনি।

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad